Sunday, May 22, 2016

Madhuchhanda Karlekar হঠাৎ একদিন ভোরবেলা, সেটা ১৯৮৩ সাল, দুই বন্ধু এসে খবর দিল রণজয় আর নেই। বিশ্বাস করতে পারি নি প্রথমে। তোতোর বাড়ি গিয়ে দেখলাম তোতো ঘুমিয়ে আছে, ঠিক যেমনটা প্রায়ই সকালে এসে দেখতাম আর খোঁচা মেরে ঘুম থেকে তুলতাম। কাউকে কোন সুযোগ না দিয়ে এবার ঘুমের মধ্যেই তোতো কোখায় যেন চলে গেল। পাশে আধখোলা Ernest Becker-এর The Birth and Death of Meaning, যে বইটা এক সময় তোতোই আমায় পড়িয়েছিল।

সেদিন বলেছিলাম যাদবপুরে আমার জীবনে সেরা প্রাপ্তি তোতো (রণজয় কার্লেকার)-র সঙ্গে বন্ধুত্ব। সমস্যা হল তোতোকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে আমার বিশেষণের ভান্ডার দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। বুদ্ধিজীবি কথাটা বহু ব্যবহৃত হতে হতে আজ প্রায় অর্থহীন হয়ে পড়েছে। তাও বলি তোতোর মত মেধাবী, মননশীল, বৌদ্ধিকচর্চায় নিয়োজিত মানুষ জীবনে বোধহয় আর একজনকেই দেখেছি - যাদবপুরে আমার দর্শনের শিক্ষক শচীন গঙ্গোপাধ্যায়। সাহিত্যের ছাত্র, কিন্তু ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান সর্বত্র অবাধ বিচরণ। কিন্তু এটুকু বললে কিছুই বলা হয় না। তথাকথিত বুদ্ধিজীবি তো জীবনে কম দেখলাম না। কিন্তু বুদ্ধিচর্চার সঙ্গে শরীরচর্চাতেও তোতোর কোন জুড়ি আজ অব্দি চোখে পড়ে নি। ক্যরাটে শিখেছিল, বক্সিং করতে খুব ভালবাসত। অসম্ভব গায়ের জোর ছিল। পাঞ্জায় কেউ কোনদিন হারাতে পেরেছে বলে শুনি নি। সমাজের সর্বস্তরে, যাদবপুরের কলোনী থেকে মনোহরপুকেরের বস্তি পর্যন্ত, সর্বত্র ছিল তোতোর বন্ধু। সবার তোতোদা।
যাদবপুরে আমাদের ছাত্র জীবনে তোতোর মত জনপ্রিয় আর কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। নেতৃত্বদানের ক্ষমতা ছিল সহজাত। অপরিসীম সাহস (নৈতিক ও শারীরিক দুটোই) ছিল। প্রচন্ড আড্ডাবাজ, অসম্ভব বন্ধু বৎসল, চেনা অচেনা লোকের বিপদে আপদে বিনা দ্বিধায় তোতো ঝাঁপিয়ে পড়ত। তোতো বা তোতোদাকে সেই সময় গোটা যাদবপুরে একডাকে সবাই চিনত। প্রসঙ্গত, যাদবপুরে শিক্ষকতা করার সময়ও কাউকে কোনদিন স্যার বলতে শুনি নি। তোতো চিরকালই ছিল সর্বজনীন তোতোদা।
তোতো গোড়ায় আমার দু ক্লাস ওপরে পড়ত। কিন্তু দু’বার এমএ পরীক্ষায় বসেও পরীক্ষা শেষ করতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত আমরা ১৯৬৮ সালে একসঙ্গে পাশ করে বেরোই। শেষ করতে না পারার কারণ হল একটা বা দুটো প্রশ্নের উত্তর লিখতেই তোতোর চার ঘন্টা কেটে যেত। মনে আছে একবার আমাদের বিভাগীয় প্রধান সুবোধ সেনগুপ্ত বলেছিলেন যে বাইরের (external) পরীক্ষকরা ওঁর কাছে জানতে চাইতেন এই ছেলেটি কে, এত অসামান্য লেখে কিন্ত দুটো প্রশ্নের বেশি উত্তর দেয় না কেন। যাই হোক শেষ পর্যন্ত তো পাশ করে বেরোল এবং বলা বাহুল্য প্রথম শ্রেনীতে। প্রসঙ্গত বলে রাখি সে সময় প্রথম শ্রেনী আজকের মত এত সুলভ ছিল না। চার পাঁচ বছরে হয়ত একজন পেতো, কখনো তাও না। কিছু দিনের মধ্যেই যাদবপুরে ইংরেজী বিভাগেই শিক্ষক হিসাবে যোগ দিল তোতো।
যাদবপুরে তোতোর ঘর ছিল ছাত্রদের তীর্থস্থান। বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীর ভিড় সব সময় লেগে থাকত। তাদের হাজারো প্রশ্ন, হাজারো আবদার। আমরা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যেতাম, কিন্তু তোতো সব সময় হাসি মুখে। শুধু কি বিশ্ববিদ্যালয়ে? বাড়িতেও সারাদিন ছাত্রছাত্রীদের ভিড় লেগে থাকত। একটা প্রশ্ন আমাকে চিরকাল বিচলিত করেছে – তোতো পড়াশোনা করত কখন? শুনেছি প্রেসিডেন্সি কলেজে অমর্ত্য সেনের সহপাঠীদেরওে একই প্রশ্ন ছিল।
সন্ধ্যে হলেই প্রায় প্রতিদিন আমরা বন্ধুরা জমায়েত হতাম রাসবিহারি ট্র্যাংগুলার পার্কের বাড়িতে। একতলায় থাকত তোতোরা, দোতলায় তোতোর মাসী মেসো, সেখানে ছিল ‘সন্দেশ’-এর অফিস। সেখানে আসতেন সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার এবং রায় বাড়ির আরো অনেকে। মাসিমা, তোতোর মা, ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের নাতনি। মৃত্যুর আগে জীবনানন্দ দাশ, তোতোর মেসোমশাইএর ভাই, ওই বাড়িতেই ছিলেন। অনেক রাত অব্দি আমাদের আড্ডা চলত। অনেক সময় অন্যরা বাড়ি চলে গেলেও তোতো আমাকে আটকে রাখতো। আমি তখন একা, কোন চাপ নেই। আমরা দুজনেই খুব খেতে ভালবাসতাম (আমি এখনও বাসি)। যখন তখন আমাদের খিদে পেতো। অনেকদিন হয়েছে রাত দুটো আড়াইটের সময় আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম লেক মার্কেটের কাছে মহাপ্রভু মিষ্টান্ন ভান্ডারে। তখন কারিগররা পরের দিনের জন্য মিষ্টি বানিয়ে সবে ঘুমের তোড়জোড় করছে। মিষ্টি কিনে খেতে খেতে অত রাতে আমরা বাড়ি ফিরে আসতাম। তারপর ভোর হলে প্রেমা ভিলাসে গিয়ে কফি আর গরম গরম ইডলি খেয়ে বাড়ি ফিরে ঘুম।
আর একবার, তখন আমি হিন্দুস্তান রোডে তোতোদের বাড়ির কাছেই থাকি। রাত এগারোটায় আমার জানালায় টোকা। তোতো দাঁড়িয়ে। হঠাৎ খুব নিজামের রোল খেতে ইচ্ছে হয়েছে। ট্যাক্সি নিয়ে এসেছে। আমি তো এক পায়ে খাড়া। নিজামে গিয়ে রোল খেয়ে মাঝ রাতের পর বাড়ি ফিরে এলাম।
আরেকটি দিনের কথা মনে পড়ছে। তখন থাকি ডোভার লেনে। একটাই ঘর, একটা খুব পুরোন ফ্রীজ, নেওয়ারের একটা খাট, জানালায় একটা দড়ি, তাতে আমার কাপড়চোপড় ঝোলে, আর এক কোনে একটা কেরোসিনের স্টোভ, স্বপাক আহার করি। খুব ভোরবেলা জানালায় টোকা, খুলে দেখি হাসি হাসি মুখে তোতো, সঙ্গে ছন্দা (তোতোর স্ত্রী) আর ছোট্ট তিমা। সারারাত ঘুমোয় নি, পড়াশোনা করেছে। ভোরবেলা মনে হয়েছে আমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাবে, তাই সপরিবারে হাজির। আমি টোস্ট বানালাম, ডিম ভাজলাম, পাড়ার দোকান থেকে জিলিপি কিনে নিয়ে এলাম, চা বানালাম। খেয়েদেয়ে বলল এবার বাড়ি গিয়ে ঘুম লাগাবো। কোথায় কি! ঘন্টা দুয়েক পরে দেখি চানটান করে ফিটফাট হয়ে তোতো কার্লেকার আবার হাজির। ঠিক করেছে দুপুরের খাওয়াটাও নাকি আমার সঙ্গেই করবে। আমার কোন চিন্তা নেই, রান্না নাকি নিজেই করবে। এসব ব্যপারে তর্ক করে লাভ নেই জানি। বলল, প্রথমে আলু ভাজবে। দিলাম গোটা কয়েক আলু বার করে। একটা ছুরি দিয়ে মোটামোটা করে সেগুলো কাটলো, তারপর স্টোভ জ্বেলে কড়াইয়ে খানিকটা তেল ঢেলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আলুগুলো তার মধ্যে ছেড়ে দিল। তারপর যা হুওয়ার তাই হল। রান্নাটা শেষ পর্যন্ত আমাকেই করতে হল। তাতে তোতো খুব একটা লজ্জা পেল বলে আমার কিন্তু মনে হল না।
১৯৭১ সালে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে ঢুকছে। তোতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলা বাহূল্য,সঙ্গে আমি। উদ্বাস্তু ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে কম বয়সি ছেলেদের নিয়ে বসিরহাটের কাছে মসলন্দপুরে একটা আমবাগানে তৈরি হল ট্রেনিং ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। চেতলা স্কুলের শারীরবিজ্ঞানের শিক্ষক সরোজদা সেখানে রয়ে গেলেন। নানা ধরণের দৌড়ঝাঁপ, শরীরচর্চা চলত সকাল থেকে। টাকা পয়সা বেশি নেই আমাদের। ক্যাম্পের জন্য শস্তায় চাল, ডাল, আলু কিনতে তোতো আর আমি বড়বাজারে আলুপোস্তা, ডালপোস্তা, চালপোস্তায় ঘুরে বাজার করতাম। সপ্তাহের শেষে সেগুলি পৌঁছে দিতাম মসলন্দপুরের ক্যাম্পে।
হঠাৎ একদিন ভোরবেলা, সেটা ১৯৮৩ সাল, দুই বন্ধু এসে খবর দিল রণজয় আর নেই। বিশ্বাস করতে পারি নি প্রথমে। তোতোর বাড়ি গিয়ে দেখলাম তোতো ঘুমিয়ে আছে, ঠিক যেমনটা প্রায়ই সকালে এসে দেখতাম আর খোঁচা মেরে ঘুম থেকে তুলতাম। কাউকে কোন সুযোগ না দিয়ে এবার ঘুমের মধ্যেই তোতো কোখায় যেন চলে গেল। পাশে আধখোলা Ernest Becker-এর The Birth and Death of Meaning, যে বইটা এক সময় তোতোই আমায় পড়িয়েছিল।

No comments:

Post a Comment