শারদ্বত মান্না
মিতাকে আমি ভাল করে চিনতাম না। আমিও, ওরই মত, যাদবপুরে বাংলা পড়তাম। ক্লাস করে ফেরার সময় সিঁড়িতে দেখা হত কখনো-সখনো। একই ব্যাচ, একই বিভাগ, বিষয়ও এক, কিন্তু এরকম হয়েই থাকে, আমার বন্ধুমহল আর ওর বন্ধুমহল আলাদা ছিল। আলাপ হয়েছিল রি-ইউনিয়নে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ডিপার্টমেন্ট সাজানোর, আর আমাকে সাহায্য করার জন্য ছিল আরো দশ-বারোজন, তাদের মধ্যে মিতাও ছিল। টানা চার-পাঁচদিন শোলা কেটে রঙ করে আঠা দিয়ে ঘর সাজাতে সাজাতে রি-ইউনিয়নের আগের দিন খুব ক্লান্ত হয়ে ও বলেছিল, ‘এত খাটলাম, কিছু খাওয়াবি না?’ অগত্যা সবাই মিলে ঝালমুড়ি, যার যা রেস্ত। ওইটুকুই। পাশ করে যাওয়ার পরে কনভোকেশনেও দেখা, ওই, হাই-হ্যালো। তারপর অভীক-সমন্বিতা-দিব্যর ফেসবুক ওয়াল থেকে জানতে পারলাম, মিতা বিয়ে করেছে। লাইক, কনগ্র্যাচুলেশনের কমেন্ট, যোগাযোগ শেষ।
অবশ্য ও চলে যাওয়ার পর ওর বাড়ি গিয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে মিতার কথা তুলে এনে যা যা জানা গেল, সেগুলো জানা থাকলে লড়াই কাকে বলে, তাও জানা হত। মিতার বাড়ি গড়িয়ার শান্তিনগরে। কাঠের পুল দিয়ে নালা পেরিয়ে যে গলির মধ্যে ওর বাড়ি, তার রাস্তার চারপাশে এখনো নবমীর বৃষ্টির থই থই জল। মিতার বাড়িতে টালির চাল, দরমার দেওয়াল। বাবার আয়ের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। দিন গেলে ১৫০-২০০ টাকা। দুই দাদার একমাত্র বোন মিতা যাদবপুরে পড়ার সময় বইখাতার খরচ আর হাত খরচ তুলত সেলাই করে, পাড়ার কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়েকে টিউশন পড়িয়ে। মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ যুগিয়েছেন। সেলাইয়ের খুব ভাল কাজ জানত, বন্ধুদেরও টুকটাক ব্লাউজ-কুর্তি বানিয়ে দিয়েছে ও। এত কষ্টের পরিবেশেও কী একটা মনে পড়াতে শিঞ্জিনী হাসতে হাসতে বলছিল, ‘ভাব, ব্যাগ থেকে ফিতে বার করে ক্লাসরুমেই আমার মাপ নিয়েছিল’... এই মেয়ে যে এত লড়াই করে যাদবপুরে পড়তে এসেছে, সেটা যাদবপুরের সৌভাগ্য। আমরা মধ্যবিত্তরা জীবনযুদ্ধের কীই বা জানি?
মিতা টাকাপয়সা নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে ছিল, পাই-পয়সা ধার রাখত না বন্ধুদের কাছে। ওর বিয়ের পর যাদবপুরের বন্ধুদের সঙ্গে ওর দেখা হয় এমফিল পরীক্ষার দিন। শ্বশুরবাড়ির সুখ্যাতি করেছিল বেশ কয়েকবার। কোনো একবার চায়ের দামের পাঁচটাকা দিতে না পারায় যখন খুব লজ্জিত, তখন দিব্য-অভীক বলেছিল, ‘সাধ’-এ তো মেয়েদের ডাকবি। আমরা তো ডাক পাব সেই তোর বাচ্চার অন্নপ্রাশনে, তখন পাঁচটাকা কেটে রেখে গিফট দেব। রসিকতার পাত্রী লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে- এরকম ইয়ার্কি আমরা দিয়েই থাকি, কিন্তু আমরা কিংবা মিতার বাড়ির মানুষরা, কেউই জানতাম না কত কিছু মিতা লুকিয়ে যাচ্ছে আমাদের সবার কাছে। মিতা বাপের বাড়ির সবার কাছে লুকিয়ে গেছে, যে বিয়ের আগে অনেকদিনের সম্পর্কই ছিল ওর আর রানার। যেমন, মিতার কাছে রানা চেপে গেছে তার মদের নেশার কথা। একবার, মাত্র একবারই বিয়ের পর বাপের বাড়িতে মিতা বলেছিল, বর খুব মদ খায়। বন্ধুদের কাছেও বলেনি এ কথা। শুধু বৌদিকে একবার বলেছিল, ক’দিন আগে, ওর অনেক কথা জমে আছে, বলার মত। পুজোয় বাপের বাড়ি এলে বৌদিকে বলবে সব। চতুর্থীতে মিতা বাপের বাড়ি আসে, সপ্তমীর দিন রানা ওকে শ্বশুরবাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তার পরের ঘটনাগুলো আমরা সোশ্যাল মিডিয়া আর পেপারে পড়েছি।
মিতা যাদবপুরে বাংলা এম.এ.তে আমাদের সঙ্গেই ভর্তি হয় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে। ২০১৫র ডিসেম্বরে আমাদের কনভোকেশন হয়ে যায়। মিতা বিয়ে করে ২২শে এপ্রিল ২০১৬। দশমীর বিকেল-সন্ধ্যে নাগাদ অনলাইন মিডিয়ায় আমরা খবর পাই, আমাদের মিতা মারা গেছে, রিপোর্টে ‘আত্মহত্যা’ নয়, সরাসরি ‘গলা টিপে ঝুলিয়ে দেওয়া’র কথা উল্লেখ করা আছে।
মিতার বাড়িতে রানার ফোন আসে দশমীর দিন, ১১ই অক্টোবর ভোরে, ৫.০০-৫.৩০ নাগাদ। রানা ফোনে বলে, ‘আপনাদের মেয়ে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে।’ তার ১৫ মিনিট পরেই আবার ফোন করে বলে, ‘আপনাদের মেয়ে মারা গেছে।’ পাড়া থেকে কোনোমতে গাড়িভাড়া করে মিতার বাড়ির লোকজন সঞ্জীবন নার্সিং হোমে পৌঁছলে মিতার মৃতদেহের কাছে তার বাড়ির কোনো মানুষকে দেখা যায় না, রানা কোথাও নেই। মিতার শ্বশুরবাড়ির সবারই কেমন যেন আক্রমনাত্মক ভাব। যে মেয়ে আত্মহত্যা করে, তার স্বামীর তো শোকে বিহবল হওয়ার কথা, সে কেন নিখোঁজ? মিতার কাকাশ্বশুর বলে, ‘আপনাদের মেয়ে সুইসাইড নোট লিখে গেছে’। সুইসাইড নোট কোথায়, এই প্রশ্ন করতেই সে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে প্রায় পালিয়ে যায় কেন? এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলে মিতার নিথর দেহ দেখে। এমনই আত্মহত্যা করেছে মিতা, যাতে তার নাক-কান দিয়ে প্রচণ্ড রক্ত পড়েছে। রক্তের ধারায় মুখ ভেসে চুল পর্যন্ত চাপ চাপ রক্তে ভরে গেছে। কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে অনেকটা। গলায় আর ঘাড়ে আঁচড়ের গভীর ক্ষত। একটা কানের লতি ছিঁড়ে গেছে। বাহুতে আঙুলের ছাপ পড়ে কালশিটে পড়ে গেছে। গলায় গভীর কালো দাগ, তা আঙুলে হতে পারে, দড়িতেও হতে পারে, আবার দুটোই, মানে, আঙুলের পরে দড়ি ব্যবহার করেও হতে পারে। মিতার হাতের শাঁখা-পলা, হাতের মেহেন্দি, পায়ের আলতা, দাম্পত্যের সবকিছুর চিহ্ন তখনও রয়ে গেছে। আত্মহত্যাই, কারণ রানার বাড়ির লোকজন এই ঘটনাকে খুব ‘স্বাভাবিক-মৃত্যু’ ‘আত্মহত্যা’ বলে তার মৃতদেহ খুব তাড়াতাড়ি দাহ করার চেষ্টা করছিল।
মিতা যে ঘরে ‘আত্মহত্যা’ করেছে, তার খাট এত উঁচুতে, আর সিলিং এতই নিচুতে, সে ঘরে খাটের ওপর দাঁড়ালে পাখার ব্লেড মিতার গলায় লাগার কথা – মিতার ছোড়দার থেকে এমনই জানা গেল। ঝোলার স্থান নেই যেখানে, সেখানে ফ্যানে ঝুলে পড়ে সে ‘আত্মহত্যা’ করল? এত আঘাত তাহলে সে কখন পেল? সঞ্জীবন নার্সিংহোম, যেখানে চাকরি করে মিতার স্বামী রানা, সেখানকার রিপোর্টে কেন লেখা হল আঘাত কেবলমাত্র গলার চারপাশে? মৃত্যুর কারণ কেন লেখা হল, ঝুলে পড়ার জন্য দম আটকে মৃত্যু হয়েছে তার? ডাক্তাররা কি রক্ত চেনেন না? আঁচড়ের দাগ চেনেন না? ব্রেনে হ্যামারেজ না হলেও, এমনি এমনিই নাক কান দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত বেরিয়ে আসা খুব স্বাভাবিক ঘটনা- এমনটাই কি মনে হয়েছিল সঞ্জীবন নার্সিংহোমের ডাক্তারদের? আমরা সত্যিই জানি না, কেবল শুনেছি, উড়ো কথাও হতে পারে, যে জমিতে সঞ্জীবন হাসপাতাল তৈরি হয়েছে তার বেশ কিছুটার প্রাক্তন মালিক রানার পরিবার। ওই হাসপাতালে তার পরিবারের দাপট আছে, রানার ওই হাসপাতালের টেকনিশিয়ানের চাকরিও সেখানেই পাওয়া। যেখানে মিতার মৃত্যু হয়েছে, পুলিশ সেই ঘরটিকে সিল করেনি এখনও। প্রমাণ লোপাট হতেই পারে, খাটের অবস্থান বদলে দিলেই মিতার ‘আত্মহত্যা’র পক্ষে যুক্তি সাজাতে পারবে খুনিরা। মিতার স্বামী-শ্বশুর ধরা পড়লেও দেওর-শাশুড়ি এখনও পলাতক। হ্যাঁ, মিতার খুন হওয়ার সময় তারা সেই বাড়িতেই উপস্থিত ছিল। খুন হওয়া মেয়ের পরিজনকে নার্সিংহোমে ঢোকার মুখে মিতার শাশুড়ি বলেছিল, ‘আপনার মেয়ের খুব জেদ।’ তখনও ভয় পায়নি সে। কুশবেড়িয়ার মণ্ডলপাড়ায় মিতার শ্বশুরবাড়ি, সেখানে সমস্ত মানুষই রানাদের আত্মীয়, সরাসরি না হলেও জ্ঞাতি তো বটেই। তাই খুন হওয়া মিতার বাড়ির মানুষ যখন নার্সিংহোমে, হাসপাতালের মর্গে, থানায় দৌড়াদৌড়ি করছেন, সব জায়গায় তাঁদের প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে। পুলিশ এফআইআর নিতে চায়নি, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে তাঁদের। শেষে পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, দুশ-আড়াইশ লোকের হাত থেকে মিতার আত্মীয়-পরিজনকে বাঁচানোর জন্য র্যাফ দিয়ে প্রোটেকশন দিয়ে হাওড়া পর্যন্ত তাঁদের এগিয়ে দিয়ে যেতে বাধ্য হয় পুলিশ।
এর সঙ্গে আরো অনেকগুলো ছোট-ছোট আপাত-বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছিল, যেগুলো জুড়লে,ব্যাপারটা আর অনেকটা পরিষ্কার হয়। মিতা চতুর্থীর দিন বাড়িতে এসে বলে, ও বি.এড. পড়তে চায়, তার অনেক খরচ। শ্বশুরবাড়ি থেকে অল্প কিছু টাকাই পাওয়া যাবে, বাকিটার জন্য বাবার কাছ থেকে ওর একলাখ টাকার দরকার। আর, খুন হওয়ার মাসদুয়েক আগে আমাদেরই সহপাঠী, ওর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে জানায়, ও কনসিভ করেছিল, তারপর সদ্য অ্যাবরশন করতে হয়েছে ওকে। এই বিশেষ বিশেষ ঘটনাগুলো কি আমাদের খুব চেনা ছকের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে না?
খুব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ঘটনা কী, কিন্তু আমাদের দেশে আইনের শাসন এমনই হাস্যকর যে, বহু মানুষের সমর্থন না পেলে তা বলবৎ হয় না। আমরা, মিতার বন্ধুরা ভয় পাচ্ছি, মিতা সুবিচার পাবে না। কারণ, মিতার পরিবারের লোকবল নেই, অর্থবল নেই, দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের সামর্থ্য নেই। আমরা ভয় পাচ্ছি, বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চা আর প্রগতিশীলতার কেন্দ্র যাদবপুরের তথাকথিত আধুনিক ছাত্রী হয়েও মিতা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হল দেখে। আমরা, মিতার বন্ধুরা আর আত্মীয় পরিজনরা এখনো জানি না কী ভাবে এগবো, জানি না, এই লড়াই কীভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে। আপনারা, যাঁরা এই লেখাটি পড়ছেন, তাঁরা সবাই মিতার পাশে, মিতার পরিবারের পাশে এসে না দাঁড়ালে মিতার সুবিচার নিশ্চিত করা যাবে না।
পুনশ্চঃ যাঁরা রক্তে ভেসে যাওয়ার ছবি, পোস্ট-মর্টেম হওয়ার পরের ছবি সহ্য করতে পারেন না, তাঁদের বিনীতভাবে জানাই, আমিও এরকম দৃশ্য সহ্য করতে পারি না। কিন্তু বাধ্য হয়েই করতে হচ্ছে, যাতে পরিকল্পিত হত্যাটা 'আত্মহত্যা' না বানানো হয়। আমার-আপনার রুচিশীলতা মিতার সুবিচার পাওয়ার রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে, এটা চাই না।
দশমীর দিন চলে যেতে হয় এক লক্ষ্মীকে... আর আমাদের লক্ষ্মীপুজোর শোরগোলের মধ্যে, প্রশ্নগুলো থেকেই যায়...
No comments:
Post a Comment