Srirupa Manna
“সরকারী চাকুরে”! এই প্রশ্নের সামনে আর অনেককাল মাথা নামাতে হয়নি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের একটা বড় অংশের তরুণ তরুণীদের। সরকারি চাকরির সুখ আর নিরাপত্তা থাকলেও সংখ্যা কম হওয়ার কারণেই গত দশ বছরের বেশী সময় ধরেই বড় একটা শিক্ষিত অংশ ঝুঁকেছিল নতুন তৈরী হওয়া চাকরির ক্ষেত্র আইটি সেক্টরে। টাই, শ্যুট, বুট, ঝকঝকে ইংলিশ, গ্ল্যামারাস অফিস বিল্ডিং দিয়ে সাজানো একটা স্মার্ট উপস্থাপনা এবং প্রত্যেকদিন সীমা বাড়তে থাকা এই ক্ষেত্রটির প্রতি স্বাভাবিক ভাবেই চাহিদা বাড়ছিল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও। কিন্তু গত চার বছর ধরেই প্রায়, সেখানেও তো নেমে আসছে একের পর এক আঘাত। যদিও ২০০৭ এর ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ এর জুন পর্যন্ত প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে যে রিসেশন এর থাবা এসে পড়েছিল, তার ঢেউ এসে ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে পড়লেও, সামলে নেওয়া গিয়েছিলো আইটির নতুন বাজার আর এখানকার প্রচুর অল্প খরচের শ্রমশক্তির জোগানের ফলে। কিন্তু শেষ রক্ষা হচ্ছে না, কারণ পুঁজিবাদের যে গভীর মূলগত সমস্যা তার কারণেই। প্রযুক্তি নির্ভর এই কর্মক্ষেত্রটিতে এবার কর্মহীন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল, প্রযুক্তির উন্নতির কারণেই। অটোমেশন আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি র নিত্যনতুন আবিষ্কারের ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আজ একটি যন্ত্র প্রতিস্থাপন করতে পারে কয়েকশো মানুষের কাজকে। আর ঠিক এই কারণেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে এই সেক্টরে কাজ করতে থাকা হাজার হাজার কর্মী। কিছুদিন আগেই ২০১৪য়, টিসিএস এরকমই একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছিল যাতে চল্লিশ হাজার কর্মীর কাজ হারানোর সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধিতার মুখে পড়ে এই বিপুল সঙ্খ্যক কর্মী ছাঁটাই থেকে বিরত থাকে কোম্পানী যদিও অন্যান্য কোম্পানি যথা আইবিএম, ইনফোসিস কিন্তু কোন নোটিশ ছাড়াই ছাঁটাই করে দেয় অনেক কর্মীকে এবং সেটা সম্পূর্ণ আড়ালে এমনকি প্রচারমাধ্যমেরও আলো বাঁচিয়ে।এমনিতেই এই সেক্টরের সমস্যা অনেক। প্রায় গোটাটাই বেসরকারি ক্ষেত্র হওয়ার কারণে, দায় গ্রহণে অসম্মত প্রায় প্রতিটি কোম্পানি। বড় কোম্পানীগুলি ছাড়াও ছোট ছোট যত কোম্পানী আছে এই ক্ষেত্রটিকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য, সেই কোম্পানীগুলির না আছে কোন ভবিষ্যত না আছে শ্রম আইন মতে কাজ করার কোন নির্দিষ্ট সময়-ঘন্টার হিসেব, মেয়ে কর্মীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি বা অন্যান্য অধিকার। কারণ এই সেক্টরে কাজ করতে থাকা লক্ষ লক্ষ কর্মীর মধ্যে খুব সুচারু ভাবে একটা কর্পোরেট আবহাওয়া প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে বেসরকারী ছোট থেকে বড় বড় মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীগুলো, যা ফলে উদয়াস্ত শ্রমশক্তি দিতে থাকা কর্মীরা কিছুতেই নিজেদের বেতনপ্রাপ্ত শ্রমিক বলে মনে করতে পারেন না, উলটে চাকরির অনিশ্চয়তা, পারফরম্যান্স প্রেশার ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করে দেয় একজনকে আর একজনের থেকে। আর ঠিক এখানেই জিতে গেছে এই কোম্পানীগুলো, যেহেতু মালিক শ্রমিক শোষণ সম্পর্ক সরাসরি এসে পড়ে না লোকচক্ষুর সামনে তাই অজস্র রকমের ঘটে চলা শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আইটি কর্মীদের রুখে দাঁড়ানোর কোন প্রক্রিয়াও অনুপস্থিত আজ। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রই নেই শ্রম আইনের আওতায়, তাই এই ধরণের শ্রমিক ছাঁটাই থেকে, বেঠিক শ্রমমূল্য নির্ধারণ কোন কিছুর বিরুদ্ধেই আওয়াজ ওঠে না। কিন্তু আজও যদি না কর্মীরা একজোটে ঘুরে দাঁড়ান নিজেদের অধিকার এর জন্য তাদের ‘শ্রমিক’ অবস্থান থেকে নিজেদের প্রাপ্য জুঝে নেওয়ার জন্য... তাহলে কালকের ঐ ছাঁটাই এর খাঁড়া হয়তো আপনার ঘাড়েও এসে পড়তে পারে আর কর্মহীন চল্লিশ হাজারের তালিকাতে আপনার নামটাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
No comments:
Post a Comment