আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ও বাবা সাহেব ডঃ বি আর আম্বেদকর
http://saradindu-uddipan.blogspot.com/…/04/blog-post_25.html
“এমন দিন আসবে যখন আমাদের নিরবতা (ফাঁসি) তোমাদের লড়াইয়ের আওয়াজ থেকেও অধিকতর শক্তিশালী হবে”।
১৮৮৬ সালের ৭ই অক্টোবর ফাঁসির আগে এ কথা শুনিয়ে ছিলেন আগস্ট স্পীজ। স্পীজের এই ভাষণ মূলত মে দিবসের এক প্রামান্য দলিল যার থেকে আমরা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে পারি।
স্পীজ বলেছিলেন। “ আমরা মানুষকে তাদের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সামাজিক সম্পর্কের কথা জানাতে চেয়েছিলাম। মানুষ যে সামাজিক ব্যবস্থা, সামাজিক কানুন এবং পরিস্থিতির মধ্যে বাস করে আমরা তা বর্ণনা করেছিলাম। আমরা সামাজিক অসাম্যের মূল কারণগুলি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমীক্ষা করে প্রশ্নাতীত ভাবে মজুরী ব্যবস্থাকে শ্রমিকদের সামনে আনতে চেয়েছিলাম। আমরা আরো বলেছিলাম যে এই মজুরী ব্যবস্থা হল এমন একটি বিকাশ ব্যবস্থা যা যুক্তি গ্রাহ্য হবে, উন্নততর সভ্যতার পথ দেখাবে এবং সামাজিক সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। এই তত্ত্ব বা পরিকল্পনা যা আমরা গ্রহণ করেছিলাম তা কেবলমাত্র পছন্দ ছিল তা নয়, ভবিষ্যৎ সমাজ ব্যবস্থার জন্যেও প্রয়োজনীয় ছিল। বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থায় বিকাশের এই ঝোঁককে নৈরাজ্য বলে মনে হলেও এটি হবে সার্বভৌম রাজতন্ত্র ও শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া যেখানে নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা ও আর্থিক সমতার ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং প্রাকৃতিক নিয়মের ভিত গড়ে দেবে”।
(Address of August Spies (October 7, 1886), From Voices of A People's History, edited by Zinn and Arnove)
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট হিসেবে বলা যায় যে, ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সময়কালে ঔপনিবেশিক ব্যবসাবানিজ্য, বিপুল পরিমাণ পুঁজি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের অর্থনীতিতে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচীত হয়েছিল। এই সময় থেকেই প্রচলিত কৃষিকাজ থেকে রাষ্ট্র ক্রমশ শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে। শিল্পের হাত ধরেই সূচনা হয় পুঁজিবাদের। শিল্পায়নের শর্ত হিসেবে পর্যাপ্ত পুঁজি এবং কাঁচামাল সাথে সাথে প্রয়োজন হয় সস্তা শ্রমিকের যোগান। ফলে শিল্প কারখানা স্থাপনের সাথে সাথে উৎপাদক বা শ্রমজীবী মানুষেরও সমাগম ঘটতে থাকে। পুঁজিবাদ যেহেতু মুনাফার নিরিখে বাঁধা তাই শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের থেকে উপর্যুপরি উৎপাদন এবং অধিক পরিমাণে মুনাফা হয়ে ওঠে পুঁজিপতিদের প্রধান লক্ষ্য। উৎপাদনক্ষেত্রের পরিকাঠামোয় থেকে যায় নানা ত্রুটি। ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার খাটুনি, কম বেতন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মহিলাদের জন্য অব্যবস্থা, দাসত্ব এবং অমানুষিক জীবনযাপনের এই ত্রুটি বিচ্যুতি ক্রমশ অসন্তোষের জন্ম দেয়। ১৮৭২ সালে কানাডায় কলকারখানায় অব্যবস্থা, শ্রমিকদের জীবন ও অধিকার নিয়ে এক বিশাল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৮৮৪ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কাজের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। শ্রমিকরা তাদের দাবীগুচ্ছকে ১৮৮৬ সালের ১লা মে’র মধ্যে কার্যকরী করতে হবে বলে মালিকপক্ষকে সময় বেঁধে দেন। কালাতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরেও মালিকপক্ষ এই দাবীগুচ্ছ মেনে না নিলে শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করে। ১৮৮৬ সালের ৪ঠা মে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক শিকাগোর হেমার্কেট স্কোয়ারে জমা হয়ে মিটিং শুরু করেন। মিটিং এর শেষ পর্যায়ে আচমকা এক বোমা বিস্ফোরণে ৬৬ জন পুলিশকর্মী আহত হলে পুলিশবাহিনী শ্রমিকদের উপর হামলা শুরু করে এতে ১১জন শ্রমিক নিহত হয়। পুলিশবাহিনী অগাস্ট স্পীজ সহ ৮জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং ৬ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ফাঁসির রায় শোনার পর স্পীজ আদালতের উদ্দেশ্যে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন সেই বিবৃতিই মূলত মে দিবসের প্রামান্য দলিল।
১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় কংগ্রেসে ১লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
দেশে দেশে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য নানা আইন তৈরি হলেও পুঁজি নির্ভর অর্থনীতিতে মুনাফা লুন্ঠনের প্রবণতাও বেড়ে চলেছে দিন দিন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমতা প্রতিষ্ঠার পথে এই প্রবণতা সবথেকে বড় অন্তরায়। অনিবার্য কারণেই আগ্রাসী অর্থনীতি ও অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে নানা দেশে নানা নামে। ঐতিহাসিক কারণেই অগাস্ট স্পীজের সেই মর্মবাণী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার লাভের পথে এখনো অদম্য শক্তির উৎস। স্পেনের ১৫এম মুভমেন্ট, অ্যামেরিকার ওকুপাই মুভমেন্ট, কানাডার এন্টি-কনজুমারিস্ট মুভমেন্ট এই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য এখনো যে স্থিতিশীল কিছু করে উঠতে পারেনি এই আন্দোলনগুলি তার অন্যতম নিদর্শন।
বিশ্ব শ্রমিক দিবসে ডঃআম্বেদকরের প্রাসঙ্গিকতাঃ
অধুনা অর্থনৈতিক বিকাশের সাথে সাথে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার নীতি নির্ধারণে ডঃ বি আর আম্বেদকর অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। আক্ষরিক অর্থে তিনি ছিলেন শ্রমজীবী বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে শ্রম দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৪২ সালে আম্বেদকর ভাইসরয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের প্রতিনিধি হিসেবে শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে সংস্কারমূলক আইন কানুন ও নীতি রুপায়নে মনোনিবেশ করেন তা যেন অগাস্ট স্পীজের শোষণহীন ভারসাম্য যুক্ত সামাজিক ন্যায় বিচারেরই এক অবিকল প্রতিচ্ছবি। মে দিবসের গঠনতন্ত্রের সাথে সহমত পোষণ করে বাবাসাহেব আম্বেদকর তার সীমিত সময় কালের মধ্যে (১৯৪২-১৯৪৬) এমন কিছু নির্দেশিকা এবং আইন কার্যকর করেন যা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা ফিরে পেতে রক্ষাকবচের কাজ করে। এক ঝলকে এই আইন, কানুন এবং নীতিগুলি দেখলেই বোঝা যায় কী পরম মমতার সাথে আম্বেদকর শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ক্ষময়য়ন ও অস্তিত্ব রক্ষায় ব্রতী ছিলেন।
শ্রমমন্ত্রী হিসেবে আম্বেদকরের সংস্কারঃ
• ১৯৪২ সালের ২৭শে নভেম্বর ইন্ডিয়ান লেবার কনফারেন্সের ৭ম অধিবেশনে একটি নির্দেশ জারি করে
• ১২-১৪ ঘণ্টা কাজের পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা করা হয়।
• মেটার্নিটি বেনিফিট অ্যাক্ট
• ওমেন লেবার ওয়েলফেয়ার ফান্ড
• ওমেন এন্ড চিলড্রেন লেবার প্রোটেকশন অ্যাক্ট
• মহিলাদের ভূগর্ভে কয়লা খনিতে কাজ করা বন্ধ করেন
• ইন্ডিয়ান ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট
• ন্যাশনাল এমপ্লয়মেন্ট এক্সেঞ্জ
• এমপ্লয়ীস স্টেট ইন্সিওরেন্স (ইএসআই)
• ইন্ডিয়াস ওয়াটার পলিসি এন্ড ইলেকট্রিক পাওয়ার প্লানিং
• ডিয়ারনেস আলাউন্স (ডিএ) টু ওয়ার্কার
• রিভিশন অব স্কেল অব পে ফর এমপ্লয়ীস
• কোল এন্ড মাইকা মাইন প্রোভিডেন্ড ফান্ড, ১৯৪৬
• লেবার ওয়েলফেয়ার ফান্ড, ১৯৪৪
• পোষ্ট ওয়ার ইকনোমিক প্লানিং
• ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ল
• ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন (আমেন্ডমেন্ট) বিল, ১৯৪৩
• দামোদর ভ্যালি প্রজেক্ট এন্ড হিরাকুদ প্রজেক্ট, ১৯৪৫
• হেলথ ইন্সিওরেন্স স্কিম
• প্রোভিডেন্ড ফান্ড অ্যাক্ট
• ফ্যাক্টরি আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট
• লেবার ডিস্পিউট অ্যাক্ট
• মিনিমাম ওয়েজেজ
• লিগাল স্ট্রাইক অ্যাক্ট
এই সমস্ত সংস্কারমূলক কাজগুলিকে বাবাসাহেব আম্বেদকর পরবর্তীকালে ভারতীয় সংবিধানে সমন্বিত করেছিলেন যাতে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ একটি শক্ত রক্ষা কবজ পায়। মে দিবসের গঠনতন্ত্রের সাথে ভারতীয় প্রেক্ষাপটটি যুক্ত করে বাবা সাহেব বলেছিলেন, প্রাচীন কাল থেকেই ভারতের শ্রম বিভাজন স্থায়ী ভাবে জাত নির্ভর যা প্রগতির পথে অন্তরায় এবং ধ্বংসাত্মক। শিল্প গতিশীল। শিল্পের প্রগতির কারণেই শ্রমিককে তার জাতপাত থেকে অবশ্যই মুক্ত থাকতে হবে। যদি হিন্দু জাতি ব্যবস্থায় এই পরিবর্তন সাধিত না হয় তবে শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মহীনতা তৈরি হবে। তিনি অনবদ্য দক্ষতায় ভারতীয় সংবিধানে জাত ব্যবস্থার সমস্ত সমস্যার নিরসন করে শ্রমজীবী মানুষের জীবনকে সুরক্ষিত করেছেন এবং মানুষকে মর্যাদার দিক থেকেও একাত্ম করার চেষ্টা করেছেন। মানুষের আত্মমর্যাদার এই একিকরণের প্রয়াস নিঃসন্দেহে সার্বভৌম সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার পক্ষে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ যা মে দিবসের ভাষণে আগস্ট স্পীজের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল।
গত ৬ই ডিসেম্বর বাবা সাহেব ডঃ বি আর আম্বেদকরের মহাপরিনির্বাণ দিবসে দিল্লীর বিজয় ভবনে লেবার এন্ড এমপ্লয়মেন্ট মিনিস্ট্রি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নোবেল বিজয়ী মাননীয় কৈলাস সত্যার্থী তাই যথার্থ বলেছেন, “It was because of Babasahebs farsightedness that most of the critical labour issues including forced labour, maternity benefit for women and working conditions were discussed and included in the Constitution of India when a large majority of the world was still discussing the means to address these issues”.
তত্ত্ব সূত্রঃ
1. Address of August Spies (October 7, 1886), From Voices of A People's History, edited by Zinn and Arnove
2. Progress of Industrial Revolution in England : History of Europe (1789-1945), J.N ghosh and Sons
3. The Doctor and the Saint Ambedkar, Gandhi the battle against caste by Arundhuti Roy
4. Some Unknown facts about Dr. Ambedkar on 'MAY DAY' also known as 'LABOR DAY' Compiled & Edited by CBA (Channel Babasaheb Ambedkar) Community Media
5. Volume 10 – Dr. Babasaheb Ambedkar as member of the Governor-General’s Executive Council (1942-46).
6. জাত ব্যবস্থার বিলুপ্তি : Dr. B.R. Ambedkar অনুবাদঃ রঞ্জিত শিকদার, ডঃ আম্বেদকর প্রকাশনী
7. Tribute to Dr. Ambedkar, Labor and Employment Ministry.
http://saradindu-uddipan.blogspot.com/…/04/blog-post_25.html
“এমন দিন আসবে যখন আমাদের নিরবতা (ফাঁসি) তোমাদের লড়াইয়ের আওয়াজ থেকেও অধিকতর শক্তিশালী হবে”।
১৮৮৬ সালের ৭ই অক্টোবর ফাঁসির আগে এ কথা শুনিয়ে ছিলেন আগস্ট স্পীজ। স্পীজের এই ভাষণ মূলত মে দিবসের এক প্রামান্য দলিল যার থেকে আমরা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে পারি।
স্পীজ বলেছিলেন। “ আমরা মানুষকে তাদের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সামাজিক সম্পর্কের কথা জানাতে চেয়েছিলাম। মানুষ যে সামাজিক ব্যবস্থা, সামাজিক কানুন এবং পরিস্থিতির মধ্যে বাস করে আমরা তা বর্ণনা করেছিলাম। আমরা সামাজিক অসাম্যের মূল কারণগুলি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমীক্ষা করে প্রশ্নাতীত ভাবে মজুরী ব্যবস্থাকে শ্রমিকদের সামনে আনতে চেয়েছিলাম। আমরা আরো বলেছিলাম যে এই মজুরী ব্যবস্থা হল এমন একটি বিকাশ ব্যবস্থা যা যুক্তি গ্রাহ্য হবে, উন্নততর সভ্যতার পথ দেখাবে এবং সামাজিক সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। এই তত্ত্ব বা পরিকল্পনা যা আমরা গ্রহণ করেছিলাম তা কেবলমাত্র পছন্দ ছিল তা নয়, ভবিষ্যৎ সমাজ ব্যবস্থার জন্যেও প্রয়োজনীয় ছিল। বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থায় বিকাশের এই ঝোঁককে নৈরাজ্য বলে মনে হলেও এটি হবে সার্বভৌম রাজতন্ত্র ও শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া যেখানে নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা ও আর্থিক সমতার ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং প্রাকৃতিক নিয়মের ভিত গড়ে দেবে”।
(Address of August Spies (October 7, 1886), From Voices of A People's History, edited by Zinn and Arnove)
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট হিসেবে বলা যায় যে, ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সময়কালে ঔপনিবেশিক ব্যবসাবানিজ্য, বিপুল পরিমাণ পুঁজি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের অর্থনীতিতে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচীত হয়েছিল। এই সময় থেকেই প্রচলিত কৃষিকাজ থেকে রাষ্ট্র ক্রমশ শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে। শিল্পের হাত ধরেই সূচনা হয় পুঁজিবাদের। শিল্পায়নের শর্ত হিসেবে পর্যাপ্ত পুঁজি এবং কাঁচামাল সাথে সাথে প্রয়োজন হয় সস্তা শ্রমিকের যোগান। ফলে শিল্প কারখানা স্থাপনের সাথে সাথে উৎপাদক বা শ্রমজীবী মানুষেরও সমাগম ঘটতে থাকে। পুঁজিবাদ যেহেতু মুনাফার নিরিখে বাঁধা তাই শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের থেকে উপর্যুপরি উৎপাদন এবং অধিক পরিমাণে মুনাফা হয়ে ওঠে পুঁজিপতিদের প্রধান লক্ষ্য। উৎপাদনক্ষেত্রের পরিকাঠামোয় থেকে যায় নানা ত্রুটি। ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার খাটুনি, কম বেতন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মহিলাদের জন্য অব্যবস্থা, দাসত্ব এবং অমানুষিক জীবনযাপনের এই ত্রুটি বিচ্যুতি ক্রমশ অসন্তোষের জন্ম দেয়। ১৮৭২ সালে কানাডায় কলকারখানায় অব্যবস্থা, শ্রমিকদের জীবন ও অধিকার নিয়ে এক বিশাল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৮৮৪ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কাজের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। শ্রমিকরা তাদের দাবীগুচ্ছকে ১৮৮৬ সালের ১লা মে’র মধ্যে কার্যকরী করতে হবে বলে মালিকপক্ষকে সময় বেঁধে দেন। কালাতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরেও মালিকপক্ষ এই দাবীগুচ্ছ মেনে না নিলে শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করে। ১৮৮৬ সালের ৪ঠা মে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক শিকাগোর হেমার্কেট স্কোয়ারে জমা হয়ে মিটিং শুরু করেন। মিটিং এর শেষ পর্যায়ে আচমকা এক বোমা বিস্ফোরণে ৬৬ জন পুলিশকর্মী আহত হলে পুলিশবাহিনী শ্রমিকদের উপর হামলা শুরু করে এতে ১১জন শ্রমিক নিহত হয়। পুলিশবাহিনী অগাস্ট স্পীজ সহ ৮জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং ৬ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ফাঁসির রায় শোনার পর স্পীজ আদালতের উদ্দেশ্যে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন সেই বিবৃতিই মূলত মে দিবসের প্রামান্য দলিল।
১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় কংগ্রেসে ১লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
দেশে দেশে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য নানা আইন তৈরি হলেও পুঁজি নির্ভর অর্থনীতিতে মুনাফা লুন্ঠনের প্রবণতাও বেড়ে চলেছে দিন দিন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমতা প্রতিষ্ঠার পথে এই প্রবণতা সবথেকে বড় অন্তরায়। অনিবার্য কারণেই আগ্রাসী অর্থনীতি ও অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে নানা দেশে নানা নামে। ঐতিহাসিক কারণেই অগাস্ট স্পীজের সেই মর্মবাণী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার লাভের পথে এখনো অদম্য শক্তির উৎস। স্পেনের ১৫এম মুভমেন্ট, অ্যামেরিকার ওকুপাই মুভমেন্ট, কানাডার এন্টি-কনজুমারিস্ট মুভমেন্ট এই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য এখনো যে স্থিতিশীল কিছু করে উঠতে পারেনি এই আন্দোলনগুলি তার অন্যতম নিদর্শন।
বিশ্ব শ্রমিক দিবসে ডঃআম্বেদকরের প্রাসঙ্গিকতাঃ
অধুনা অর্থনৈতিক বিকাশের সাথে সাথে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার নীতি নির্ধারণে ডঃ বি আর আম্বেদকর অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। আক্ষরিক অর্থে তিনি ছিলেন শ্রমজীবী বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে শ্রম দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৪২ সালে আম্বেদকর ভাইসরয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের প্রতিনিধি হিসেবে শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে সংস্কারমূলক আইন কানুন ও নীতি রুপায়নে মনোনিবেশ করেন তা যেন অগাস্ট স্পীজের শোষণহীন ভারসাম্য যুক্ত সামাজিক ন্যায় বিচারেরই এক অবিকল প্রতিচ্ছবি। মে দিবসের গঠনতন্ত্রের সাথে সহমত পোষণ করে বাবাসাহেব আম্বেদকর তার সীমিত সময় কালের মধ্যে (১৯৪২-১৯৪৬) এমন কিছু নির্দেশিকা এবং আইন কার্যকর করেন যা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা ফিরে পেতে রক্ষাকবচের কাজ করে। এক ঝলকে এই আইন, কানুন এবং নীতিগুলি দেখলেই বোঝা যায় কী পরম মমতার সাথে আম্বেদকর শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ক্ষময়য়ন ও অস্তিত্ব রক্ষায় ব্রতী ছিলেন।
শ্রমমন্ত্রী হিসেবে আম্বেদকরের সংস্কারঃ
• ১৯৪২ সালের ২৭শে নভেম্বর ইন্ডিয়ান লেবার কনফারেন্সের ৭ম অধিবেশনে একটি নির্দেশ জারি করে
• ১২-১৪ ঘণ্টা কাজের পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা করা হয়।
• মেটার্নিটি বেনিফিট অ্যাক্ট
• ওমেন লেবার ওয়েলফেয়ার ফান্ড
• ওমেন এন্ড চিলড্রেন লেবার প্রোটেকশন অ্যাক্ট
• মহিলাদের ভূগর্ভে কয়লা খনিতে কাজ করা বন্ধ করেন
• ইন্ডিয়ান ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট
• ন্যাশনাল এমপ্লয়মেন্ট এক্সেঞ্জ
• এমপ্লয়ীস স্টেট ইন্সিওরেন্স (ইএসআই)
• ইন্ডিয়াস ওয়াটার পলিসি এন্ড ইলেকট্রিক পাওয়ার প্লানিং
• ডিয়ারনেস আলাউন্স (ডিএ) টু ওয়ার্কার
• রিভিশন অব স্কেল অব পে ফর এমপ্লয়ীস
• কোল এন্ড মাইকা মাইন প্রোভিডেন্ড ফান্ড, ১৯৪৬
• লেবার ওয়েলফেয়ার ফান্ড, ১৯৪৪
• পোষ্ট ওয়ার ইকনোমিক প্লানিং
• ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ল
• ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন (আমেন্ডমেন্ট) বিল, ১৯৪৩
• দামোদর ভ্যালি প্রজেক্ট এন্ড হিরাকুদ প্রজেক্ট, ১৯৪৫
• হেলথ ইন্সিওরেন্স স্কিম
• প্রোভিডেন্ড ফান্ড অ্যাক্ট
• ফ্যাক্টরি আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট
• লেবার ডিস্পিউট অ্যাক্ট
• মিনিমাম ওয়েজেজ
• লিগাল স্ট্রাইক অ্যাক্ট
এই সমস্ত সংস্কারমূলক কাজগুলিকে বাবাসাহেব আম্বেদকর পরবর্তীকালে ভারতীয় সংবিধানে সমন্বিত করেছিলেন যাতে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ একটি শক্ত রক্ষা কবজ পায়। মে দিবসের গঠনতন্ত্রের সাথে ভারতীয় প্রেক্ষাপটটি যুক্ত করে বাবা সাহেব বলেছিলেন, প্রাচীন কাল থেকেই ভারতের শ্রম বিভাজন স্থায়ী ভাবে জাত নির্ভর যা প্রগতির পথে অন্তরায় এবং ধ্বংসাত্মক। শিল্প গতিশীল। শিল্পের প্রগতির কারণেই শ্রমিককে তার জাতপাত থেকে অবশ্যই মুক্ত থাকতে হবে। যদি হিন্দু জাতি ব্যবস্থায় এই পরিবর্তন সাধিত না হয় তবে শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মহীনতা তৈরি হবে। তিনি অনবদ্য দক্ষতায় ভারতীয় সংবিধানে জাত ব্যবস্থার সমস্ত সমস্যার নিরসন করে শ্রমজীবী মানুষের জীবনকে সুরক্ষিত করেছেন এবং মানুষকে মর্যাদার দিক থেকেও একাত্ম করার চেষ্টা করেছেন। মানুষের আত্মমর্যাদার এই একিকরণের প্রয়াস নিঃসন্দেহে সার্বভৌম সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার পক্ষে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ যা মে দিবসের ভাষণে আগস্ট স্পীজের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল।
গত ৬ই ডিসেম্বর বাবা সাহেব ডঃ বি আর আম্বেদকরের মহাপরিনির্বাণ দিবসে দিল্লীর বিজয় ভবনে লেবার এন্ড এমপ্লয়মেন্ট মিনিস্ট্রি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নোবেল বিজয়ী মাননীয় কৈলাস সত্যার্থী তাই যথার্থ বলেছেন, “It was because of Babasahebs farsightedness that most of the critical labour issues including forced labour, maternity benefit for women and working conditions were discussed and included in the Constitution of India when a large majority of the world was still discussing the means to address these issues”.
তত্ত্ব সূত্রঃ
1. Address of August Spies (October 7, 1886), From Voices of A People's History, edited by Zinn and Arnove
2. Progress of Industrial Revolution in England : History of Europe (1789-1945), J.N ghosh and Sons
3. The Doctor and the Saint Ambedkar, Gandhi the battle against caste by Arundhuti Roy
4. Some Unknown facts about Dr. Ambedkar on 'MAY DAY' also known as 'LABOR DAY' Compiled & Edited by CBA (Channel Babasaheb Ambedkar) Community Media
5. Volume 10 – Dr. Babasaheb Ambedkar as member of the Governor-General’s Executive Council (1942-46).
6. জাত ব্যবস্থার বিলুপ্তি : Dr. B.R. Ambedkar অনুবাদঃ রঞ্জিত শিকদার, ডঃ আম্বেদকর প্রকাশনী
7. Tribute to Dr. Ambedkar, Labor and Employment Ministry.
No comments:
Post a Comment