Monday, February 1, 2016

মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জীবন ও কর্ম

মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জীবন ও কর্ম

Jagadish Roy

জন্ম ও শিক্ষাঃ- যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলার গৌরনদী থানাধীন মৈস্তাকান্দি গ্রামের একদরিদ্র নমঃ পরিবারে, 1904 সালের 29 শে January. পিতা-রামদয়াল মন্ডল ও মাতা –সন্ধ্যারাণী মন্ডল। তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ ও সর্বকিনিশঠ সন্তান। তিনি বাল্যকালে খুবই দুরন্ত ছিলেন। আর বছর পর্যন্ত তাঁকে বিদ্যালয়ে পাঠানো সম্ভব হয়নি। একটু বেশী বয়সে লেখাপড়া শুরু করলেও তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। অল্পকালের মধ্যেই পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। 1924 সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
যোগেন্দ্রনাথের পিতার আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য তিনি তাঁকে কলেজে পড়াতে অসমর্থ হলে যোগেন্দ্রনাথের কাকা কলেজের খরচা বহন করেন, আর বরিশালের বি.এম. কলেজে ভর্তি হন এবং 1926 সালে কৃতিত্বের সহিত I.A. পাশ করেন। পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আর্থিক সাহায্য পাওয়ার জন্য তিনি ওখানকার নিবাসী প্রহ্লাদ চন্দ্র বাড়ৈ-এর দ্বিতীয় কন্যা কমলা বাড়ৈকে বিবাহ করেন। তারপর 1929 সালে ঐ কলেজ থেকে তিনি অঙ্ক ও সংস্কৃতে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে B.A. পাশ করেন।
তিনি M.A. পড়তে চাওয়ার কথা জানালে শ্বশুর মহাশয়ের তাঁর অসামর্থের কথা জানান। তখন যোগেন্দ্রনাথ মাত্র 11 টাকা সম্বল করে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ঢাকা যান। ঢাকায় পড়াশুনা না করতে পেরে তিনি কলকাতায় এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে ভর্তি হন এবং চাঁদসী চিকিৎসক প্যারীমোহন দাসের বাড়িতে লজিং থেকে ছাত্র পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করেন।এছাড়া পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি ছাপাখানায় প্রুফ সংশোধনের কাজ করতেন। 1934 সালের জুলাই মাসে তিনি সসম্মানে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। 1936 সালের 25শে জুলাই আইনজীবি হসাবে বরিশাল সদর আদালতে যোগদান করেন। এই সময় তিনি দরিদ্র কৃষকদের অনেক মমলা কোনরূপ ফি না নিয়েই করে দেন।
1937 সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসাবে তিনি বাখরগঞ্জ উত্তর-পূর্ব নির্বাচন কেন্দ্র থেকে কংগ্রসী প্রার্থী জমিদার সরল দত্তকে বিপুর ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
স্কুল ও কলেজ জীবনে বর্ণবৈষ্যম্যের স্বীকারঃ-
(১) একদিন ক্লাশে এক ব্রাহ্মণ ছাত্রের পাশে যোগেন্দ্রনাথ বসলে, সেই দাম্ভিক ব্রাহ্মণ কুমার ঘৃণায় ভ্রুকুঞ্চিত করে তীব্র শ্লেষোক্তি করে, “এই নমঃর স্পর্ধা দেখছ; ও কিনা আমার পাশে এসে, গায়ে গা ঘেঁসে বসতে চায়!” বর্ণ হিন্দু ছাত্ররা একত্রে তার কথা সমর্থন করে বলে, “ঠিক বলেছিস, ওকে এখান থেকে সরিয়ে দাও।” সকলে মিলে যখন তাঁকে সরানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না, তিনি দৃঢ় কন্ঠে প্রতিবাদ করে বললেন, “আমি এখান থেকে এক চুলও নড়ব না । এ স্কুল শুধু তোমাদের জন্য নয়। এখানে সরাবই বসার অধিকার আছে।” কিশোর যোগেন্দ্রনাথ তখন থেকে এই রূঢ় সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হলেন।
(২)কলকাতার ব্রজমোহন কলেজে সরস্বতী পূজায় তফসিলী ছাত্রদের পূজাগৃহের বাইরে দাঁড়িয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিতে হ’ত, যেটা সুদীর্ঘকাল ধরে চলছিল। যোগেন্দ্রনাথ এই বৈষ্যম্যের প্রতিবাদ করেন। তিনি একত্রে পুষ্পঞ্জালি দেওয়ার কথা বললে, বর্ণ হিন্দু ছাত্ররা তফসিলী ছাত্রদের সঙ্গে একত্রে পুষ্পাঞ্জলি দিতে রাজি হয় না। এই নিয়ে তিব্র বাক বিতন্ডা হয়। তখন দৃঢ়চেতা যোগেন্দ্রনাথ অনুন্নত শ্রেণীর ছাত্রদের নিয়ে ঐ কলেজের অন্যত্র পৃথক পূজার বন্দোবস্ত করেন।
(৩)একবার যোগেন্দ্রনাথের একজন কলেজের বন্ধু বরিশাল শহরে কালীবাড়ীর নাট মন্দিরে প্রবেশ করে দেবীর আরাধনা করলে কিছু সংখ্যক উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্ররোচনায় তাকে যথেষ্ঠ নিগ্রহ ভোগ করতে হয়। তাকে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। এই ঘটনার কথা সেই ছাত্র বন্ধুটি যোগেন্দ্রনাথকে জানালে, তিনি ক্ষোভে, দুক্ষে ফেটে পড়েন। তিনি ঐ দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদেরান্দোলন করেন। সারা শহর জুড়ে একটা হুলস্থুল সাড়া পড়ে যায়। স্থানীয় নেতৃত্ববৃন্দও চিন্তিত হন। এই উপলক্ষে অনুন্নত সম্প্রদায়ের এক বিরাট সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় যোগেন্দ্রনাথকে দলপতি বানানো হয়। সেই সভায় তীব্রভাবে ঐ অত্যাচারের নিন্দা করা হয়। তিনি দৃঢ় কন্ঠে সমস্ত বর্ণ হিন্দুদেরকে বলেদেন যে, অনুন্নত সম্প্রদায়ও মানুষের মর্যাদা দাবি করে এবং সেই দাবি রক্ষার জন্য তারা প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতে দ্রঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষের আজ সাধারণ নাগরিকের অধিকার থেকে বঞ্চিত, অবনমিত, লাঞ্ছিত ও বিপর্যস্ত। তাই এই প্রতিকার অবশ্যই করতে হবে।
তখন বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরে নেতৃবৃন্দ এই সমস্যার একটা সন্তোষজনক মীমাংসার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন। এর পরে এই ধরণের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য নেতৃবৃন্দ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করেন।
সমাজ কল্যানমূলক কাজঃ- তিনি আইনপাশ করে আইনজীবি হিসাবে দরিদ্র কৃষকদের অনেক মামলা বিনা পয়সায় করে দিতেন। M.L.A. হিসাবে তিনি নমঃ-অধ্যূষিত আগৈলঝাড়া গ্রামের ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমিকে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। উত্ত্র বরিশালের বিভিন্ন বিলের জল নিষ্কাশন, কলকাতায় তফসিলী জাতিভুক্ত পুলিশ কনস্টেবলদের আবাসস্থলের নির্মাণ, তফসিলী ছাত্রদের ৭তম শ্রেণীর পরিবর্তে ৪তুর্থ শ্রেণী থেকে বৃত্তি প্রদান, মফঃস্বল শহরের ছাত্রাবাসগুলিতে তফসিলী ছাত্রদের আসন সংরক্ষণ এবং উক্ত ছাত্রদের জন্য সরকারী অনুদানের ব্যবস্থা করেন
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল সম্পর্কে বিভিন্ন বিদ্যজনের মতামতঃ-
ডঃ সঞ্জয় গাজভিয়েঃ- সাংবিধানিক ভারতের নির্মাতা বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর ও মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।
ডঃ প্রদীপ আগলাবেঃ- বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর সামাজিক রাজনৈতিক শৈক্ষনিক ধার্মিক ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনার জন্য ঐতিহাসিক আর ক্রান্তিকারী কাজ করেছেন; সেই মহান ক্রান্তিকারী কাজ করার জন্য যে মহামানব বাবাসাহেবকে সহযোগীতা করেছেন, সেই মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের আবদান খুব মহত্ত্বপূর্ণ । যদি মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের এই সহযোগীতা বাবাসাহেব না পেতেন, তাহলে তিনি সংবিধান তৈরী করতে পারতেন না । ঐতিহাসিক সত্য ।
ডঃ প্রদীপ আগলাবেঃ- বাবাসাহেব যদি সংবিধান সভায় যেতে না পারতেন তাহলে এই দেশের সংবিধান ব্রাহ্মণদের পক্ষেই লেখা হ’ত । তাই যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আম্বেদকরী আন্দোলনে যে সহযোগীতা করেছেন এবং মূলনিবাসীদের উদ্ধারের জন্য যে কাজ করেছেন সেটা অসাধারণ কাজ
ঊষাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ঃ- ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের স্থান সম্পর্কে নানা সনের মনে যে বিভ্রান্তি বা সংশয় দেখা যায় সেটা বহুলাংশে অজ্ঞতার কারণে। তাঁকে দেশ বিভাগের জন্যেও অংশতঃ দায়ী করা হয়। অথচ তাঁরমত কর্মযোগী দেশবৎসল, স্ব-সম্প্রদায়ের উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ নেতা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে কমই দেখা গেছে।
কিরণ চন্দ্র ব্রহ্মঃ- ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেই চারিদিক হতে একটা চিৎকার প্রতিধ্বনিত হল যে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল দেশ ভাগ করেছেন, তাঁর মত সর্বনাশা লোক ভারতে আর কেউ নেই। এই মিথ্যা দোষারোপকারীরা অশ্লীল ভাষায় তাঁকে অজস্র গাল দিয়েছে। প্রকৃত পক্ষে ভারত ভাগে তাঁর কোন ভূমিকা ছিল না। তবে এই কুৎসা রটনাকারীদের উদ্দেশ্য কি তাও প্রনিধান করা করা দরকার। যারা এই মিথ্যা রটিয়েছে তারাও জানে ভারত ভাগে যোগেন্দরনাথের কোন ভূমিকাই ছিল না এবং তিনি দেশ ভাগের একান্ত বিরোধী ছিলেন। এই কুৎসা রটনার কারণ আমাদের কাছে মোটেই দুর্বোধ্য নয়। কারণ, এই দেশের নিপীড়িত মানুষের অন্তরে মহাপ্রাণ যে শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন সেটাকে নষ্ট করে দিয়ে সাধারণ মানুষের অন্তর থেকে তাঁকে চিরতরে মুছে দিতে৩ পারলে তাঁর আজীবন সংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেওয়া যায়। এই ছিল কুৎসা রটনাকারীদের মূল উদ্দেশ্য।
বাংলা বিভাজনের পক্ষে কংগ্রেস আর উচ্চবর্নীয়রা কেন ছিল সেটা জানা খুব দরকার ।
প্রথমকারনঃ- বাংলা প্রান্তে মুসলিম এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেনীর(বিশেষ করে নমঃশুদ্র) লোকদের সংখ্যা সর্বাধিক ছিল । সেখানে মুসলিম লীগের সরকার ছিল। যদি বাংলার বিভাজন না হয় তাহলে মুসলিম আর পিছিয়ে পড়া শ্রেনীর সত্তা চিরস্থায়ী হবে। সেখানে উচ্চবর্ণীয়দের কোন অধিকার থাকবে না ।
দ্বিতীয় কারনঃ- বাংলার খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল এই এলাকা থেকে বাবা সাহেবকে নির্বাচিত করে সংবিধান সভায় পাঠানো হয় । তাই বাংলা বিভাজন করে বাবাসাহেব যে ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সেখান থেকে বাবাসাহেবের সদস্য পদ খারিজ করার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাগ করে ছিল ।
তৃতীয়কারনঃ- যে নমঃ(শুদ্র)রা বাবাসাহেবকে সংবিধান সভায় নির্বাচিত করে পাঠিয়েছেলেন তাদেরকে সাজা দেওয়ার জন্য যাতে তারা আজীবন মুসলমানদের আধীন থাকে, এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য বাংলা ভাগ করেছিল ।
L

No comments:

Post a Comment