মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হচ্ছেন নারী, ব্যবহৃত হচ্ছেন যৌনদাসী হিসেবে
জনশক্তি রফতানির নামে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার করা হচ্ছে। পাচারের পর নানা নির্যাতন ছাড়াও যৌনদাসী হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে, এসব নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে পাচার করা হচ্ছে কি না, সেটা জানেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পাচার হওয়া কয়েকজন নারীর স্বজনদের অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক নারী পাচারচক্রের সন্ধানও পেয়েছেন র্যাব কর্মকর্তারা। মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হওয়া অর্ধশতাধিক নারীকে উদ্ধার ও পাচার প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও পরামর্শ দিয়েছে র্যাব।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, সোনালি ভবিষ্যতের আশায় চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়ে বেশিরভাগ নারীই পড়ছেন পাচারকারীর কবলে। পরে বাধ্যতামূলকভাবে দেহ ব্যবসা করতে বাধ্য করা হয়। কাউকে জিম্মি করে স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করেন দেশি-বিদেশি পাচারকারীরা। ওই দুষ্ট চক্রের কবল থেকে নানা কৌশলে পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও বেশিরভাগ নারীরই ভাগ্যে কী ঘটছে জানার উপায় থাকে না। ওইসব নারী বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন, তা জানেন না স্বজনরা। কোথায় কার কাছে প্রতিকার চাইতে হবে, সেটাও জানেন না তারা।
কয়েকজন নারীর স্বজনদের অভিযোগের পর র্যাব নারী পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করে। গোয়েন্দারা ওইসব তদন্ত করতে গিয়ে একটি বিশাল আন্তর্জাতিক চক্রের সন্ধান পান। যাদের এজেন্ট রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও রয়েছে। কয়েকদফা অভিযান চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি চক্রের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। র্যাবের বিভিন্ন ইউনিট এসব অভিযান চালায়। অভিযানে চক্রের বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারেন, গা শিউরে ওঠা নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার গোলাম সারোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, গত বছরের জুন মাসে প্রথম দফায় ১১ জন ও দ্বিতীয় দফায় জুলাইয়ে আরও কয়েকজনকে মানব পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। পাচারকারী চক্রে দু’টি ট্রাভেল এজেন্সির মালিকও রয়েছেন। ভালো চাকরির প্রলোভনে নারীদের প্রথমে দুবাই নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানে পাচার করা হয়। এরইমধ্যে তারা আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রকেও শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। পল্টন থানায় দায়ের হওয়া দু’টি মামলার এজাহারে বিদেশিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার জানান, বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে তারা জানতে পারেন, বেশ কিছু দালাল চক্র উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সহজ-সরল মানুষকে কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে পাচার করে আসছে। পাচারকৃতদের অধিকাংশই বিদেশে গিয়ে অবৈধ হয়ে শারীরিক নির্যাতন ও অপহরণের শিকার হচ্ছেন। আর নারীরা শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন নিপীড়নেরও শিকার হচ্ছেন।
পরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৩-এর একটি দল গত বছরের ৯ জুন রাজধানীর রামপুরা থানার মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় গোলাম রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি অ্যান্ড ট্যাভেলসে অভিযান চালায়। সেখান থেকে ট্রাভেল এজেন্সির মালিকসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট ও মানবপাচারের বিভিন্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম সারোয়ার আরও জানান, মালিবাগের অভিযানের পর সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একই মাসের ২৮ জুন রাজধানীর পুরানা পল্টন ও নয়াপল্টনে অভিযান চালিয়ে নারীপাচার চক্রের আরও ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যেও ট্রাভেল এজেন্সির মালিক ও কর্মচারী রয়েছেন। তিনি জানান, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সিরাজ সিকদার একসময় ঠেলা গাড়ি চালাতেন। পরে পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে প্রথমে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর দালালি শুরু করেন। এক পর্যায়ে নিজেই একটি ট্রাভেল এজেন্সি দেন। তার বাড়ি সাতক্ষীরায়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার আরও বলেন, দ্বিতীয় দফায় গেফতারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া যায়, কিভাবে তারা আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের যোগসাজশে সিরিয়া, লেবানন ও জর্দানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে থাকেন, এসব তথ্য। এ চক্রের হাতে প্রতারণার শিকার শাহীনুরকে কিভাবে লেবাননে পাঠানোর কথা বলে সিরিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ছয় মাস যাবত শাহীনুরের ওপর চালানো হয় শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন।
র্যাব-৩-এর অধিনায়ক সারোয়ার আরও জানান, পাচারকারীরা সিরিয়াতে শাহীনুরকে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করেন। এ অবস্থায় শাহীনুর তার মা মোসাম্মৎ খাজিদাকে অবহিত করলে তিনি র্যাবের কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেন। অব্যাহত চাপের মুখে পাচারকারীরা ভিকটিম শাহীনুরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন। পরে শাহীনুরের কাছ থেকে র্যাব কর্মকর্তারা জানতে পারেন, নারীদের ওপর নির্যাতনের রোমহর্ষক কাহিনি।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, কোহিনূর আলম নামের এক ব্যক্তি জর্ডানে থাকেন। বাংলাদেশে তার বাড়ি মানিকগঞ্জের হাজীনগরে। তার বাবার নাম সফিউদ্দিন। তিনি আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের মধ্যে বাংলাদেশি পাচারকারীদের সমন্বয় করে থাকেন। গৃহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশ থেকে প্রথমে দুবাই ও পরে জর্ডানে পাঠানো হয়। পরে সেখান থেকে সিরিয়া ও লেবাননে পাচার করে দেওয়া হয় নারীকর্মীদের। বাংলাদেশ, তাইওয়ান ও নেপালসহ কয়েকটি দেশের নারীদের পাচার করা হলেও তাদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশি নারী। কারণ, এই নারীরা অনেকটাই গরিব ও অশিক্ষিত।
তিনি জানান, আহমীর আহমেদ নামের এক জর্ডান নাগরিকের আম্মানে আল রাইস রাবিয়া ট্রাস্ট নামের একটি এজেন্সি রয়েছে। ওই এজেন্সি হয়ে সিরিয়া ও লেবাননে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সিরিয়ার দামেস্কে পৌঁছানোর পর আল মাহমুদ, আতাল, মজিদ নামের পাচারকারীরা মেয়েদের কাজের কথা বলে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করেন। আর লেবাননের বৈরুতে ওমর ও আমির দুই পাচারকারীর নাম পেয়েছেন তারা। ঢাকার পল্টন থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে তাদের নাম রাখা হলেও করার কিছুই নেই।
বাংলাদেশি নারীসহ সাধারণ মানুষ যেন পাচার না হন, সেজন্য র্যাব-৩-এর পক্ষ থেকে গত জানুয়ারিতে র্যাব সদর দফতর, স্বরাষ্ট্র ও পরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যারা পাচার হয়েছেন, তাদের কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠির সঙ্গে ৫৩ জন পাচার হওয়া নারীর নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য সংবলিত একটি তালিকাও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোয় পাঠানো হয়। যেন তাদের খুঁজে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার গোলাম সারোয়ার আরও জানান, মানবপাচারের পেছনে দেশের এক শ্রেণির রিক্রুটিং এজেন্সি জড়িত। দালালের মাধ্যমে দেশের বিভিন্নস্থান থেকে সহজ সরল নারী-পুরুষদের সংগ্রহ করে জনশক্তি রফতানির নামে তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে মানবপাচার করেন। পাচার হয়ে যাওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রে কিছুই করার থাকে না। তাদের হদিস পেলেও ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে যায়। এছাড়া অভিযোগ না থাকলে মানব পাচারকারীসহ দুর্বৃত্তদের ধরাও কঠিন হয়ে পড়ে।
No comments:
Post a Comment