মহাপ্রাণ সুন্দরবন বিপর্যস্ত হলে পুরো বাংলাদেশই অরক্ষিত হয়ে পড়বে’-অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
মহাপ্রাণ সুন্দরবন বাংলাদেশের এক অতুলনীয় সম্পদ। অসংখ্য প্রাণের সমষ্টি এবং অতুলনীয় বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেম-এর কারণে আমরা এর নাম দিয়েছি মহাপ্রাণ যা একইসঙ্গে বহু প্রাণকে রক্ষা করে। হাজার বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এ বন গড়ে উঠেছে। মানুষের দ্বারা এ ধরনের বন দ্বিতীয়টি বানানো যে সম্ভব নয়, তা কাণ্ডজ্ঞান আছে এমন যে কেউ বোঝেন। কিন্তু বোঝে না আমাদের সরকার।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান একবার এ ধরনের ঘোষণাই দিয়েছিলেন যে, তারা দরকার হলে বন তৈরি করে নিবেন! সুন্দরবনের আজকের অবস্থা হচ্ছে এই। সরকার জানে যে, তাদের প্রস্তাবিত রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হলে সুন্দরবনের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা বনের কোল ঘেঁষে লাল ক্যাটাগরির এই অত্যন্ত দূষণপ্রবণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী নিজে দুই দফায় গণমাধ্যমের সামনে এই প্রকল্পের ফলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সাথে এও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তার পরেও এই প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করবেনই।কোটি কোটি মানুষের আশ্রয় ধ্বংস হবে জেনেও সরকারকে এই প্রকল্প কেন বাস্তবায়ন করতেই হবে? কোথায় তাদের হাত-পা বাঁধা? ভারতের বৃহৎ পুঁজির কাছে? মুনাফাখোর গোষ্ঠীর কাছে? হাত-পা বাঁধা সরকার পাবার জন্য তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি নাই।
আমরা জানতে পেরেছি যে, রামপালে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ভারতীয় হেভি ইলেকট্রিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির আয়োজন চলছে। তাছাড়া দেশীয় কোম্পানি ওরিয়নকেও বনের কোল ঘেঁষে ৫৬৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির অনুমতি দিয়েছে সরকার। এভাবেই জোর আয়োজন চলছে বন ধ্বংসের। আমরা জাতীয় স্বার্থবিরোধী এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতীয় জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েই এবারের জনযাত্রা কর্মসূচির ডাক দিয়েছি।
সুন্দরবন নিয়ে সরকারের যে তৎপরতা, তাকে একদিকে আহাম্মকি অন্যদিকে দুর্বৃত্ত তৎপরতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সুন্দরবন আছে বলে প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় চার কোটি মানুষের প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে কাজ করে সুন্দরবন। অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার এ বন বিনষ্ট হওয়া মানে কয়েক লক্ষ মানুষের জীবিকা হারানো, উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষকে মৃত্যু ও ধ্বংসের হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া। কিন্তু সরকার মাত্র ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য সুন্দরবনের বিলীন হওয়াটাকে আমলে নিচ্ছে না। বন ধ্বংস করে বিদ্যুৎ? এ যেন মৃত মানুষের জন্য স্যুট-বুটের ব্যবস্থা!
আমরা বারবার বলে আসছি, সুন্দরবন না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। এটি বাংলাদেশের ফুসফুস। বিশেষজ্ঞরা নানা ধরনের সমীক্ষা ও গবেষণা প্রকাশ করেছেন নিজ উদ্যোগে। তাতে দেখা গেছে, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বনের নানা ধরনের ক্ষতির কারণ হবে। ধীরে ধীরে বনকে ঠেলে দিবে ধ্বংসের মুখে! বিশেষজ্ঞরা কিছু প্রশ্ন হাজির করেছেন, যার উত্তর সরকারের পক্ষে দেয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৩২০ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে প্রতিদিন কয়লা পোড়াতে হবে ১৩ হাজার মেট্রিক টন। অথচ একটি ইটের ভাটায় বছরে পোড়ে আড়াই হাজার মেট্রিক টন কয়লা। সুতরাং দৈনিক ১৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা পোড়ানোর অর্থ হচ্ছে, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে হাজার হাজার ইটের ভাটা জ্বালিয়ে দেয়া। যে এলাকায় একটি ইটের ভাটা আছে, সেখানকার প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ কী ধরনের হুমকিতে পড়ে তা ভুক্তভোগীরা জানেন। চিমনি দিয়ে উড়ে যাওয়া ফ্লাই অ্যাশ বা ছাইগুঁড়ো ফসলের ক্ষেত, গাছ-গাছালি ও পানিকে ক্ষতিগ্রস্ত-দূষিত করে। সেখানে এত বড় কয়ালা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাব কী হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এতে ছাই হবে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। যা থেকে বিপুল রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসরিত হবে। এছাড়া সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আসবে। তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে। ১৩২০ মেগাওয়াটের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার টন কয়লা লাগবে। এর জন্য সুন্দরবনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ নদীপথে বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিলোমিটার পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে বছরে ২৩৬ দিন হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে!
এভাবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লার গুঁড়া, ভাঙা বা টুকরো কয়লা, তেল, ময়লা-আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে নদী-খাল-মাটিসহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে। খাদ্যচক্র বিপন্ন হবে। চলাচলকারী জাহাজের ঢেউয়ে দুপাশের তীরের ভূমিক্ষয় হবে। কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ ও কয়লা লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত ব্যাপক শব্দদূষণ হবে। রাতে জাহাজ চলাচলের সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণীসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশুপাখির জীবনচক্রের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
সাপ্তাহিক : সরকার তো সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কথা বলছে?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ :কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হবে, এটা এখন সরকারই স্বীকার করেছে। তবে তারা যে সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তির কথা বলছে, বাস্তবে এটা খুবই বায়বীয় কথা। এই প্রযুক্তি দিয়ে ক্ষতি কমবে শতকরা মাত্র ১০ ভাগ। কাউকে ২০ হাত পানির নিচে ডুবিয়ে তারপর যদি ২ হাত পানি কমানো হয় তাতে ক্ষতি কী কমবে? বাঁচবে সেই মানুষ? পৃথিবীতে এ যাবৎ কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের যত প্রযুক্তি এসেছে, তার সবই পরিবেশের কমবেশি ক্ষতি করে। ভারতের কাছে এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, যা ব্যবহারে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। গত কোপেনহেগেন সম্মেলনে তো এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যই বিশ্ব নেতৃত্ব তাদের সতর্ক করেছিল। তুলনামূলক বিচারে ভারতের প্রযুক্তি জার্মানি বা উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকর। ভারত তার নিজের প্রযুক্তি ব্যবহার করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করবে। পরিবেশের ক্ষতি হবে বলেই ভারতে এই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভারত সরকার এর পর আইন সংশোধন করে এ ধরনের প্রকল্প বন বা বসতি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে করার কথা বলেছে। অথচ এখানে এসে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি নিজস্ব আইন ভঙ্গ করে বনের পাশেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে বনের যে ক্ষতি হবে তা কি কাঁটাতার দিয়ে আটকানো যাবে? অচিরেই ভারত অংশের সুন্দরবনও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমাদের দেশের সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে যা খুশি করার লাইসেন্স তৈরি করে নিয়েছে। সংসদে তারা দায়মুক্তি আইন করে নিয়েছে। যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদন যে জরুরি তা মানতে আমাদের কারোই আপত্তি নেই। কিন্তু উন্নয়নকে অবশ্যই জনবান্ধব, দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই হতে হবে, এটা বলতে গেলেই বিপত্তি। সরকার বন, প্রাণ, মানুষ, পরিবেশকে তোয়াক্কা করছে না। অথচ ভারতে আমরা দেখেছি, তাজমহলের গায়ে একটু কালো ছাপ পড়ছে দেখে আগ্রার অনেক দূরবর্তী শিল্পকেন্দ্রও সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ভারতজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী যেহেতু কিছুদিন আগে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পদক পেয়েছেন, সুতরাং তার পক্ষে বনের ক্ষতি করা সম্ভব না এই যুক্তি সরকার পক্ষের অনেকেই দিচ্ছেন। আমরা দাবি করেছিলাম যে, প্রধানমন্ত্রীর এই পদক তবেই সার্থক হবে, যদি তিনি সুন্দরবনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার কাজ বন্ধ করেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, তারা বলছে বনের ক্ষতি হলেও কাজ চলবে। যা কিনা দেখিয়ে দেয় যে, প্রধানমন্ত্রীর এক হাতে পরিবেশ রক্ষার পদক, অন্য হাতে চার কোটি মানুষ রক্ষার সুন্দরবন ধ্বংসের পরোয়ানা।
সুন্দরবন রক্ষা ও স্বনির্ভর বিদ্যুৎ-জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবিতে আমরা সাত দফা দাবি দিয়েছি। জাতীয় কমিটির এই সাত দফার মধ্যে রয়েছে জাতীয় সম্পদের ওপর জাতীয় মালিকানা নিশ্চিত করা, খনিজসম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও একে গণপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা, কয়লা উত্তোলনে উন্মুক্ত পদ্ধতি বাতিল করা, খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে শতভাগ দেশীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ শতভাগ দেশের কাজে ব্যবহার নিশ্চিত করা, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ ঘটিয়ে তাদের দ্বারা কাজ করা, রেন্টাল বাতিল করা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশবান্ধব, সুলভ স্বনির্ভর জনস্বার্থকেন্দ্রিক জ্বালানি নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা। এই সাত দফা বাস্তবায়িত হলে শুধু সুন্দরবন রক্ষা নয়, অর্জিত হবে জ্বালানি নিরাপত্তা ও নিশ্চিত হবে জাতীয় সমৃদ্ধি।
সাপ্তাহিক : সরকার কেন এসব আমলে নিচ্ছে না?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ :সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিপদ নিশ্চিত জেনে রামসার ও ইউনেসকোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে। সরকার যদি তারপরও এই কাজ অব্যাহত রাখে, তাহলে তারা বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকা থেকে সুন্দরবনের নাম বাদ দেবে বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি থেকে নরওয়ে সরকারের গ্লোবাল পেনশন ফান্ড বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থসংস্থানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। দক্ষিণ এশীয় মানবাধিকার সংস্থা সরেজমিনে তদন্ত শেষে এই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছে। এমনকি ভারতে যারা পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় সোচ্চার, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে।
সরকার যে এখন পর্যন্ত এসবের কিছুই আমলে নিচ্ছে না, এর কারণ তাদের হাত-পা কোথাও বাঁধা পড়ে আছে। সারা দেশের মানুষ ও বিশ্ববিবেক যখন বনের কোল ঘেঁষে ক্ষতিকর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে, সরকার সেখানে যেকোনো মূল্যে উন্নয়নকার্য এগিয়ে নেয়ার কথা বলে উল্টোপথে হাঁটছে। আজকের যুগের শাসকশ্রেণির উন্নয়ন দর্শনের মধ্যেই এই সংকটের বীজ নিহিত। তারা কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখে উন্নয়ন মডেল সাজায়, দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি ও জনগণের সমৃদ্ধির বদলে তাতে বিপদই বাড়ে। তাদের লক্ষ্য থাকে, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে হলেও কয়েকজনের জন্য শুধুই মুনাফা! অন্ধ মুনাফালোভী এই উন্নয়ন দর্শনই তাদের চোখে ঠুলি এঁটে দিয়েছে।
সাপ্তাহিক : শাসকশ্রেণির উন্নয়ন দর্শনটা যদি আরেকটু ব্যাখ্যা করতেন...
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ : বর্তমান উন্নয়ন দর্শনের প্রধান প্রবণতা যে মুনাফা, তা তো আগেই উল্লেখ করেছি। একে পোশাকি ভাষায় নিউলিবারেল মডেল বলে। এটা স্বৈরতন্ত্র ও সহিংসতা ছাড়া চলতে পারে না। মানুষকে উচ্ছেদ করবে, বন ধ্বংস করবে, নদী ধ্বংস করবে, পানি-বায়ু দূষণ করবে, পাহাড় উজাড় করবে, জমি দখল করবে, মানুষের নিরাপদ জীবন ও তার ভবিষ্যৎ যেসব কিছুর ওপর নির্ভরশীল, সবকিছুকেই তারা গ্রাস করবে, মুনাফার উপকরণ বানাবে। শুধু জমি দখল বা অনুপ্রবেশ নয়, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে হলেও সে তার মুনাফা নিশ্চিত করবে।
এই উন্নয়নের চেহারা তাই খুবই সহিংসতামূলক। সহিংসতা ছাড়া এ উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা যায় না। কারণ খোলা চোখেই এর ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদ ধরা পড়ে। শাসকদের তাই দমন-পীড়ন চালিয়েই এই উন্নয়ন তথা দখল-লুণ্ঠন-মুনাফার কারবার জারি রাখতে হয়। এজন্যই এই উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে চলে আসে স্বৈরশাসন। স্বৈরতন্ত্র না থাকলে এধরনের উন্নয়ন কার্যকর করা শাসকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এর প্রতিফলন আমরা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ ভারতেও দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশেও তা দেখতে পাচ্ছি। এই স্বৈরতন্ত্রের ফলে যারা লাভবান হয়, তারা তাদের হাতে থাকা প্রচারযন্ত্র, গণমাধ্যম, আমলা, বিশেষজ্ঞ দিয়ে নিজস্ব উন্নয়নের সপক্ষে প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ঘোর তৈরি করতে চেষ্টা করে। জৌলুসের আড়ালে মানুষের পায়ের নিচের মাটি কেড়ে নেয়। তারা প্রচার চালায় যে, উন্নয়ন করতে গেলে কিছু মানুষ বাধা দিবেই, তাকে পাত্তা দিলে উন্নয়ন হবে না। অর্থাৎ আমাদের স্বৈরতন্ত্র চালাতে দিতে হবে। একই প্রক্রিয়ার অপর অংশ হচ্ছে, ওই উন্নয়নের ফলে দেশবাসীর কী ক্ষতি হবে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার জোরে তারা সে বিষয়ক আলাপ-আলোচনা সমাজ থেকে অদৃশ্য করে দেয়। তথ্য গোপন করে, গণমাধ্যমগুলোকে চাপে রাখে, আন্দোলনকারীদের পথে নামতে দেয় না। এ নিয়ে গবেষণা হতে দেয় না, স্বাধীন গবেষণার পথ রুদ্ধ করে, সত্য পালটে দেয়, আচ্ছন্নতা তৈরি করে। দুর্নীতি, সম্পদ পাচার, এই উন্নয়ন মডেলের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শাসকশ্রেণির উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা এই দর্শনের প্রকাশই দেখতে পাচ্ছি। এধরনের ‘উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পগুলো পুরো দেশকেই বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সাপ্তাহিক : আমরা দেখতে পাচ্ছি, জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলন বেগবান করা যেন অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি ও জাতীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছেন? বর্তমান পরিস্থিতি কি এমন কোনো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা এ ধরনের আন্দোলন এগুনোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ : বর্তমান বৈশ্বিক পুঁজির প্রবণতা, বৈশ্বিক রাজনীতির ধরন, যাকে নিউ লিবারেল সিস্টেম বলা হচ্ছে, তার যে আধিপত্য চলছে সেটার সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই নিউ লিবারেল মডেলে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ অর্থাৎ মানুষ একেবারেই গুরুত্বহীন। এখানে কেবল যে কোনো মূল্যে ব্যক্তি-কোম্পানি-কর্পোরেশনের মুনাফা বৃদ্ধি গুরুত্ব পায়। সমস্ত কিছুকে কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে বা মালিকানায় নিয়ে আসা, মানুষের সমস্ত অধিকারের ক্ষেত্রকে মুনাফার উপকরণে পরিণত করা, সেটা শিক্ষা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, যাই হোক না কেন! এটাই নিউ লিবারেল মডেলের লক্ষ্য। এটাকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী নানা কায়দা চলছে। ওয়ার অন টেরর কর্মসূচিটা এর অংশ। এর মাধ্যমে এমন একটা ঘোর তৈরি করা হয়েছে যে, সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী রাষ্ট্রই বুক ফুলিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলছে, দেশ দখল করছে, গণহত্যা চালাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যাবে না। তাদের প্রচার, সিদ্ধান্তই শেষ কথা। এই ওয়ার অন টেরর মন্ত্র হচ্ছে বিশ্বব্যাপী নিউ লিবারেল কাঠামো প্রতিষ্ঠায় সাম্রাজ্যবাদীদের একটা রক্ষাকবচ। সন্ত্রাসের ধোঁয়া তুলে, সেটাকেই মুখ্য বানিয়ে এর ফাঁকে সবকিছুকে বিক্রিযোগ্য করে তোলাটা ও এ থেকে মুনাফা বাগিয়ে নেয়াটাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এভাবে একই মন্ত্র দিয়ে বাংলাদেশেও এক বিরোধিতাহীন একচেটিয়া দখল লুণ্ঠনকে বৈধতাদান করা হচ্ছে।
এর পাশাপাশি তরুণদের মধ্যে পণ্যের ঘোর তথা বাজারের একটা মোহ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তার মধ্যে পণ্যের চাহিদা এত তীব্র করা হচ্ছে যে, নতুন একটি পণ্য আয়ত্ত করাই যেন তার লক্ষ্য, তার জন্য তার মধ্যে আত্মকেন্দ্রিক উন্মাদনা সৃষ্টি খুব কাজে দেয়। যেকোনো মূল্যে তাকে অধিক আয় করতে হবে, প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, প্রযুক্তিপণ্যগুলো তারও হাতে আসা চাই, এভাবে সারাক্ষণ তাকে আরও চাই, আরও চাই বৃত্তের মধ্যে অস্থির ও ব্যস্ত করে রাখা হচ্ছে। কৃত্রিম চাহিদাগুলোকে প্রধান করে তুলে চিন্তার স্বাধীনতাকে সীমিত করে রাখা ও চিন্তার ক্ষমতাকে সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থানের ধরনটাও এখন এরকম। স্থায়ী কর্মসংস্থানের অনুপাত অনেক কমে গেছে। অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, আউটসোর্সিংয়ের ওপর প্রধানত জোর দেয়া হচ্ছে। এটা গ্লোবাল ও রিজিওনাল ক্যাপিটালের জন্য খুব সুবিধাজনক। এর মাধ্যমে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে হাইলি ইনসিকিউরড অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। দৈনন্দিন চাহিদার মধ্যে আটকে ফেলে তাকে দৈনন্দিন ক্লান্তিতে নিমজ্জিত রাখা হচ্ছে। ফলে সে যে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করবে, সেই সুযোগটাই কমে যায়। সে কোনো দিশা পায় না। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুর মধ্যে তার মনোযোগ আটকে ফেলা হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের বিছানো এই জালটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অদৃশ্য, তবে ভয়ঙ্কর।
বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আমরাও বিশ্বপরিসরে বিছানো এসব জালের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। এর মধ্যেই সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন ক্রমে ক্রমে দানা বাঁধছে। এই আন্দোলন শাসকশ্রেণির মুনাফাকেন্দ্রিক উন্নয়ন দর্শন এবং শাসকশ্রেণির দমন নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক দর্শনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এটা এই আন্দোলনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। মোট কথা, বিশ্বজুড়ে যে দিশাহীন অবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যে শত্রু-মিত্রের ঘোর তৈরি করা হয়েছে, নীতিহীনতা ও ভোগের যে জাল বিস্তার করা হয়েছে, তার ভেতর থেকেই জনগণ পাল্টা প্রতিরোধের রসদ সংগ্রহ করছে। আন্দোলন এগুনোর ক্ষেত্রে অনেক বাধা, কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে যে দিশা দেখা দিচ্ছে, তা আরও জনগণকে এর সঙ্গে যুক্ত করার শর্ত সৃষ্টি করছে।
সাপ্তাহিক : এই আন্দোলন বিজয়ী হওয়ার মূল শর্ত কোনটি? কোন শক্তির ওপর নির্ভর করছেন, আশার আলো কোথায়?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ :মানুষই মূল শর্ত, মূল ভরসা। ইতিহাস আমাদের পথ দেখায় যে, মানুষ এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে প্রগতির পথে এগিয়েছে। এত জাল দিয়েও শেষ পর্যন্ত মানুষকে আটকে রাখা যায় না, এটাই আশার জায়গা। তরুণদের সবার চোখ তো তারা অন্ধ করে দিতে পারেনি। আজকে এই আন্দোলন সংগঠিত করা ও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তরুণরা বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। আরও বেশি মাত্রায় জনগণের কাছে পৌঁছানো, তাদের সজাগ করা ও সংগ্রামের পথে ঐক্যবদ্ধ করাটাই আমাদের বিজয়ের মূল শর্ত। জনযাত্রা সেই কাজটাকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে। এখন আমরা আরও জোর গলায় বলতে পারি, সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে দেয়া হবে না। দেশ ও মানুষ ধ্বংসের এই ষড়যন্ত্র আমরা থামাবই। কারণ মহাপ্রাণ সুন্দরবন বিপর্যস্ত হলে পুরো বাংলাদেশই অরক্ষিত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশকে রক্ষা করতেই সুন্দরবন বাঁচাতে হবে, তার জন্য সুন্দরবিনাশী সকল প্রকল্প এবং অপতৎপরতা বন্ধ করতেই হবে।
http://www.shaptahik.com/v2/? DetailsId=11092
মহাপ্রাণ সুন্দরবন বাংলাদেশের এক অতুলনীয় সম্পদ। অসংখ্য প্রাণের সমষ্টি এবং অতুলনীয় বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেম-এর কারণে আমরা এর নাম দিয়েছি মহাপ্রাণ যা একইসঙ্গে বহু প্রাণকে রক্ষা করে। হাজার বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এ বন গড়ে উঠেছে। মানুষের দ্বারা এ ধরনের বন দ্বিতীয়টি বানানো যে সম্ভব নয়, তা কাণ্ডজ্ঞান আছে এমন যে কেউ বোঝেন। কিন্তু বোঝে না আমাদের সরকার।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান একবার এ ধরনের ঘোষণাই দিয়েছিলেন যে, তারা দরকার হলে বন তৈরি করে নিবেন! সুন্দরবনের আজকের অবস্থা হচ্ছে এই। সরকার জানে যে, তাদের প্রস্তাবিত রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হলে সুন্দরবনের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা বনের কোল ঘেঁষে লাল ক্যাটাগরির এই অত্যন্ত দূষণপ্রবণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী নিজে দুই দফায় গণমাধ্যমের সামনে এই প্রকল্পের ফলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সাথে এও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তার পরেও এই প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করবেনই।কোটি কোটি মানুষের আশ্রয় ধ্বংস হবে জেনেও সরকারকে এই প্রকল্প কেন বাস্তবায়ন করতেই হবে? কোথায় তাদের হাত-পা বাঁধা? ভারতের বৃহৎ পুঁজির কাছে? মুনাফাখোর গোষ্ঠীর কাছে? হাত-পা বাঁধা সরকার পাবার জন্য তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি নাই।
আমরা জানতে পেরেছি যে, রামপালে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ভারতীয় হেভি ইলেকট্রিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির আয়োজন চলছে। তাছাড়া দেশীয় কোম্পানি ওরিয়নকেও বনের কোল ঘেঁষে ৫৬৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির অনুমতি দিয়েছে সরকার। এভাবেই জোর আয়োজন চলছে বন ধ্বংসের। আমরা জাতীয় স্বার্থবিরোধী এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতীয় জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েই এবারের জনযাত্রা কর্মসূচির ডাক দিয়েছি।
সুন্দরবন নিয়ে সরকারের যে তৎপরতা, তাকে একদিকে আহাম্মকি অন্যদিকে দুর্বৃত্ত তৎপরতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সুন্দরবন আছে বলে প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় চার কোটি মানুষের প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে কাজ করে সুন্দরবন। অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার এ বন বিনষ্ট হওয়া মানে কয়েক লক্ষ মানুষের জীবিকা হারানো, উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষকে মৃত্যু ও ধ্বংসের হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া। কিন্তু সরকার মাত্র ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য সুন্দরবনের বিলীন হওয়াটাকে আমলে নিচ্ছে না। বন ধ্বংস করে বিদ্যুৎ? এ যেন মৃত মানুষের জন্য স্যুট-বুটের ব্যবস্থা!
আমরা বারবার বলে আসছি, সুন্দরবন না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। এটি বাংলাদেশের ফুসফুস। বিশেষজ্ঞরা নানা ধরনের সমীক্ষা ও গবেষণা প্রকাশ করেছেন নিজ উদ্যোগে। তাতে দেখা গেছে, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বনের নানা ধরনের ক্ষতির কারণ হবে। ধীরে ধীরে বনকে ঠেলে দিবে ধ্বংসের মুখে! বিশেষজ্ঞরা কিছু প্রশ্ন হাজির করেছেন, যার উত্তর সরকারের পক্ষে দেয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৩২০ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে প্রতিদিন কয়লা পোড়াতে হবে ১৩ হাজার মেট্রিক টন। অথচ একটি ইটের ভাটায় বছরে পোড়ে আড়াই হাজার মেট্রিক টন কয়লা। সুতরাং দৈনিক ১৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা পোড়ানোর অর্থ হচ্ছে, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে হাজার হাজার ইটের ভাটা জ্বালিয়ে দেয়া। যে এলাকায় একটি ইটের ভাটা আছে, সেখানকার প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ কী ধরনের হুমকিতে পড়ে তা ভুক্তভোগীরা জানেন। চিমনি দিয়ে উড়ে যাওয়া ফ্লাই অ্যাশ বা ছাইগুঁড়ো ফসলের ক্ষেত, গাছ-গাছালি ও পানিকে ক্ষতিগ্রস্ত-দূষিত করে। সেখানে এত বড় কয়ালা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাব কী হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এতে ছাই হবে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। যা থেকে বিপুল রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসরিত হবে। এছাড়া সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আসবে। তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে। ১৩২০ মেগাওয়াটের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার টন কয়লা লাগবে। এর জন্য সুন্দরবনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ নদীপথে বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিলোমিটার পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে বছরে ২৩৬ দিন হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে!
এভাবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লার গুঁড়া, ভাঙা বা টুকরো কয়লা, তেল, ময়লা-আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে নদী-খাল-মাটিসহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে। খাদ্যচক্র বিপন্ন হবে। চলাচলকারী জাহাজের ঢেউয়ে দুপাশের তীরের ভূমিক্ষয় হবে। কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ ও কয়লা লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত ব্যাপক শব্দদূষণ হবে। রাতে জাহাজ চলাচলের সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণীসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশুপাখির জীবনচক্রের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
সাপ্তাহিক : সরকার তো সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কথা বলছে?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ :কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হবে, এটা এখন সরকারই স্বীকার করেছে। তবে তারা যে সুপার ক্রিটিকাল প্রযুক্তির কথা বলছে, বাস্তবে এটা খুবই বায়বীয় কথা। এই প্রযুক্তি দিয়ে ক্ষতি কমবে শতকরা মাত্র ১০ ভাগ। কাউকে ২০ হাত পানির নিচে ডুবিয়ে তারপর যদি ২ হাত পানি কমানো হয় তাতে ক্ষতি কী কমবে? বাঁচবে সেই মানুষ? পৃথিবীতে এ যাবৎ কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের যত প্রযুক্তি এসেছে, তার সবই পরিবেশের কমবেশি ক্ষতি করে। ভারতের কাছে এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, যা ব্যবহারে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। গত কোপেনহেগেন সম্মেলনে তো এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যই বিশ্ব নেতৃত্ব তাদের সতর্ক করেছিল। তুলনামূলক বিচারে ভারতের প্রযুক্তি জার্মানি বা উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকর। ভারত তার নিজের প্রযুক্তি ব্যবহার করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করবে। পরিবেশের ক্ষতি হবে বলেই ভারতে এই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভারত সরকার এর পর আইন সংশোধন করে এ ধরনের প্রকল্প বন বা বসতি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে করার কথা বলেছে। অথচ এখানে এসে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি নিজস্ব আইন ভঙ্গ করে বনের পাশেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে বনের যে ক্ষতি হবে তা কি কাঁটাতার দিয়ে আটকানো যাবে? অচিরেই ভারত অংশের সুন্দরবনও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমাদের দেশের সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে যা খুশি করার লাইসেন্স তৈরি করে নিয়েছে। সংসদে তারা দায়মুক্তি আইন করে নিয়েছে। যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদন যে জরুরি তা মানতে আমাদের কারোই আপত্তি নেই। কিন্তু উন্নয়নকে অবশ্যই জনবান্ধব, দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই হতে হবে, এটা বলতে গেলেই বিপত্তি। সরকার বন, প্রাণ, মানুষ, পরিবেশকে তোয়াক্কা করছে না। অথচ ভারতে আমরা দেখেছি, তাজমহলের গায়ে একটু কালো ছাপ পড়ছে দেখে আগ্রার অনেক দূরবর্তী শিল্পকেন্দ্রও সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ভারতজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী যেহেতু কিছুদিন আগে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পদক পেয়েছেন, সুতরাং তার পক্ষে বনের ক্ষতি করা সম্ভব না এই যুক্তি সরকার পক্ষের অনেকেই দিচ্ছেন। আমরা দাবি করেছিলাম যে, প্রধানমন্ত্রীর এই পদক তবেই সার্থক হবে, যদি তিনি সুন্দরবনে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার কাজ বন্ধ করেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, তারা বলছে বনের ক্ষতি হলেও কাজ চলবে। যা কিনা দেখিয়ে দেয় যে, প্রধানমন্ত্রীর এক হাতে পরিবেশ রক্ষার পদক, অন্য হাতে চার কোটি মানুষ রক্ষার সুন্দরবন ধ্বংসের পরোয়ানা।
সুন্দরবন রক্ষা ও স্বনির্ভর বিদ্যুৎ-জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবিতে আমরা সাত দফা দাবি দিয়েছি। জাতীয় কমিটির এই সাত দফার মধ্যে রয়েছে জাতীয় সম্পদের ওপর জাতীয় মালিকানা নিশ্চিত করা, খনিজসম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও একে গণপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা, কয়লা উত্তোলনে উন্মুক্ত পদ্ধতি বাতিল করা, খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে শতভাগ দেশীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ শতভাগ দেশের কাজে ব্যবহার নিশ্চিত করা, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ ঘটিয়ে তাদের দ্বারা কাজ করা, রেন্টাল বাতিল করা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশবান্ধব, সুলভ স্বনির্ভর জনস্বার্থকেন্দ্রিক জ্বালানি নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা। এই সাত দফা বাস্তবায়িত হলে শুধু সুন্দরবন রক্ষা নয়, অর্জিত হবে জ্বালানি নিরাপত্তা ও নিশ্চিত হবে জাতীয় সমৃদ্ধি।
সাপ্তাহিক : সরকার কেন এসব আমলে নিচ্ছে না?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ :সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিপদ নিশ্চিত জেনে রামসার ও ইউনেসকোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে। সরকার যদি তারপরও এই কাজ অব্যাহত রাখে, তাহলে তারা বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকা থেকে সুন্দরবনের নাম বাদ দেবে বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি থেকে নরওয়ে সরকারের গ্লোবাল পেনশন ফান্ড বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থসংস্থানে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। দক্ষিণ এশীয় মানবাধিকার সংস্থা সরেজমিনে তদন্ত শেষে এই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছে। এমনকি ভারতে যারা পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় সোচ্চার, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে।
সরকার যে এখন পর্যন্ত এসবের কিছুই আমলে নিচ্ছে না, এর কারণ তাদের হাত-পা কোথাও বাঁধা পড়ে আছে। সারা দেশের মানুষ ও বিশ্ববিবেক যখন বনের কোল ঘেঁষে ক্ষতিকর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে, সরকার সেখানে যেকোনো মূল্যে উন্নয়নকার্য এগিয়ে নেয়ার কথা বলে উল্টোপথে হাঁটছে। আজকের যুগের শাসকশ্রেণির উন্নয়ন দর্শনের মধ্যেই এই সংকটের বীজ নিহিত। তারা কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখে উন্নয়ন মডেল সাজায়, দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি ও জনগণের সমৃদ্ধির বদলে তাতে বিপদই বাড়ে। তাদের লক্ষ্য থাকে, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে হলেও কয়েকজনের জন্য শুধুই মুনাফা! অন্ধ মুনাফালোভী এই উন্নয়ন দর্শনই তাদের চোখে ঠুলি এঁটে দিয়েছে।
সাপ্তাহিক : শাসকশ্রেণির উন্নয়ন দর্শনটা যদি আরেকটু ব্যাখ্যা করতেন...
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ : বর্তমান উন্নয়ন দর্শনের প্রধান প্রবণতা যে মুনাফা, তা তো আগেই উল্লেখ করেছি। একে পোশাকি ভাষায় নিউলিবারেল মডেল বলে। এটা স্বৈরতন্ত্র ও সহিংসতা ছাড়া চলতে পারে না। মানুষকে উচ্ছেদ করবে, বন ধ্বংস করবে, নদী ধ্বংস করবে, পানি-বায়ু দূষণ করবে, পাহাড় উজাড় করবে, জমি দখল করবে, মানুষের নিরাপদ জীবন ও তার ভবিষ্যৎ যেসব কিছুর ওপর নির্ভরশীল, সবকিছুকেই তারা গ্রাস করবে, মুনাফার উপকরণ বানাবে। শুধু জমি দখল বা অনুপ্রবেশ নয়, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে হলেও সে তার মুনাফা নিশ্চিত করবে।
এই উন্নয়নের চেহারা তাই খুবই সহিংসতামূলক। সহিংসতা ছাড়া এ উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা যায় না। কারণ খোলা চোখেই এর ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদ ধরা পড়ে। শাসকদের তাই দমন-পীড়ন চালিয়েই এই উন্নয়ন তথা দখল-লুণ্ঠন-মুনাফার কারবার জারি রাখতে হয়। এজন্যই এই উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে চলে আসে স্বৈরশাসন। স্বৈরতন্ত্র না থাকলে এধরনের উন্নয়ন কার্যকর করা শাসকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এর প্রতিফলন আমরা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ ভারতেও দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশেও তা দেখতে পাচ্ছি। এই স্বৈরতন্ত্রের ফলে যারা লাভবান হয়, তারা তাদের হাতে থাকা প্রচারযন্ত্র, গণমাধ্যম, আমলা, বিশেষজ্ঞ দিয়ে নিজস্ব উন্নয়নের সপক্ষে প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ঘোর তৈরি করতে চেষ্টা করে। জৌলুসের আড়ালে মানুষের পায়ের নিচের মাটি কেড়ে নেয়। তারা প্রচার চালায় যে, উন্নয়ন করতে গেলে কিছু মানুষ বাধা দিবেই, তাকে পাত্তা দিলে উন্নয়ন হবে না। অর্থাৎ আমাদের স্বৈরতন্ত্র চালাতে দিতে হবে। একই প্রক্রিয়ার অপর অংশ হচ্ছে, ওই উন্নয়নের ফলে দেশবাসীর কী ক্ষতি হবে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার জোরে তারা সে বিষয়ক আলাপ-আলোচনা সমাজ থেকে অদৃশ্য করে দেয়। তথ্য গোপন করে, গণমাধ্যমগুলোকে চাপে রাখে, আন্দোলনকারীদের পথে নামতে দেয় না। এ নিয়ে গবেষণা হতে দেয় না, স্বাধীন গবেষণার পথ রুদ্ধ করে, সত্য পালটে দেয়, আচ্ছন্নতা তৈরি করে। দুর্নীতি, সম্পদ পাচার, এই উন্নয়ন মডেলের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শাসকশ্রেণির উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা এই দর্শনের প্রকাশই দেখতে পাচ্ছি। এধরনের ‘উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পগুলো পুরো দেশকেই বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সাপ্তাহিক : আমরা দেখতে পাচ্ছি, জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলন বেগবান করা যেন অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি ও জাতীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছেন? বর্তমান পরিস্থিতি কি এমন কোনো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা এ ধরনের আন্দোলন এগুনোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ : বর্তমান বৈশ্বিক পুঁজির প্রবণতা, বৈশ্বিক রাজনীতির ধরন, যাকে নিউ লিবারেল সিস্টেম বলা হচ্ছে, তার যে আধিপত্য চলছে সেটার সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই নিউ লিবারেল মডেলে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ অর্থাৎ মানুষ একেবারেই গুরুত্বহীন। এখানে কেবল যে কোনো মূল্যে ব্যক্তি-কোম্পানি-কর্পোরেশনের মুনাফা বৃদ্ধি গুরুত্ব পায়। সমস্ত কিছুকে কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে বা মালিকানায় নিয়ে আসা, মানুষের সমস্ত অধিকারের ক্ষেত্রকে মুনাফার উপকরণে পরিণত করা, সেটা শিক্ষা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, যাই হোক না কেন! এটাই নিউ লিবারেল মডেলের লক্ষ্য। এটাকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী নানা কায়দা চলছে। ওয়ার অন টেরর কর্মসূচিটা এর অংশ। এর মাধ্যমে এমন একটা ঘোর তৈরি করা হয়েছে যে, সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী রাষ্ট্রই বুক ফুলিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলছে, দেশ দখল করছে, গণহত্যা চালাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যাবে না। তাদের প্রচার, সিদ্ধান্তই শেষ কথা। এই ওয়ার অন টেরর মন্ত্র হচ্ছে বিশ্বব্যাপী নিউ লিবারেল কাঠামো প্রতিষ্ঠায় সাম্রাজ্যবাদীদের একটা রক্ষাকবচ। সন্ত্রাসের ধোঁয়া তুলে, সেটাকেই মুখ্য বানিয়ে এর ফাঁকে সবকিছুকে বিক্রিযোগ্য করে তোলাটা ও এ থেকে মুনাফা বাগিয়ে নেয়াটাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এভাবে একই মন্ত্র দিয়ে বাংলাদেশেও এক বিরোধিতাহীন একচেটিয়া দখল লুণ্ঠনকে বৈধতাদান করা হচ্ছে।
এর পাশাপাশি তরুণদের মধ্যে পণ্যের ঘোর তথা বাজারের একটা মোহ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তার মধ্যে পণ্যের চাহিদা এত তীব্র করা হচ্ছে যে, নতুন একটি পণ্য আয়ত্ত করাই যেন তার লক্ষ্য, তার জন্য তার মধ্যে আত্মকেন্দ্রিক উন্মাদনা সৃষ্টি খুব কাজে দেয়। যেকোনো মূল্যে তাকে অধিক আয় করতে হবে, প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, প্রযুক্তিপণ্যগুলো তারও হাতে আসা চাই, এভাবে সারাক্ষণ তাকে আরও চাই, আরও চাই বৃত্তের মধ্যে অস্থির ও ব্যস্ত করে রাখা হচ্ছে। কৃত্রিম চাহিদাগুলোকে প্রধান করে তুলে চিন্তার স্বাধীনতাকে সীমিত করে রাখা ও চিন্তার ক্ষমতাকে সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থানের ধরনটাও এখন এরকম। স্থায়ী কর্মসংস্থানের অনুপাত অনেক কমে গেছে। অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, আউটসোর্সিংয়ের ওপর প্রধানত জোর দেয়া হচ্ছে। এটা গ্লোবাল ও রিজিওনাল ক্যাপিটালের জন্য খুব সুবিধাজনক। এর মাধ্যমে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে হাইলি ইনসিকিউরড অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। দৈনন্দিন চাহিদার মধ্যে আটকে ফেলে তাকে দৈনন্দিন ক্লান্তিতে নিমজ্জিত রাখা হচ্ছে। ফলে সে যে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করবে, সেই সুযোগটাই কমে যায়। সে কোনো দিশা পায় না। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুর মধ্যে তার মনোযোগ আটকে ফেলা হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের বিছানো এই জালটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অদৃশ্য, তবে ভয়ঙ্কর।
বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আমরাও বিশ্বপরিসরে বিছানো এসব জালের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। এর মধ্যেই সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন ক্রমে ক্রমে দানা বাঁধছে। এই আন্দোলন শাসকশ্রেণির মুনাফাকেন্দ্রিক উন্নয়ন দর্শন এবং শাসকশ্রেণির দমন নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক দর্শনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এটা এই আন্দোলনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। মোট কথা, বিশ্বজুড়ে যে দিশাহীন অবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যে শত্রু-মিত্রের ঘোর তৈরি করা হয়েছে, নীতিহীনতা ও ভোগের যে জাল বিস্তার করা হয়েছে, তার ভেতর থেকেই জনগণ পাল্টা প্রতিরোধের রসদ সংগ্রহ করছে। আন্দোলন এগুনোর ক্ষেত্রে অনেক বাধা, কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে যে দিশা দেখা দিচ্ছে, তা আরও জনগণকে এর সঙ্গে যুক্ত করার শর্ত সৃষ্টি করছে।
সাপ্তাহিক : এই আন্দোলন বিজয়ী হওয়ার মূল শর্ত কোনটি? কোন শক্তির ওপর নির্ভর করছেন, আশার আলো কোথায়?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ :মানুষই মূল শর্ত, মূল ভরসা। ইতিহাস আমাদের পথ দেখায় যে, মানুষ এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে প্রগতির পথে এগিয়েছে। এত জাল দিয়েও শেষ পর্যন্ত মানুষকে আটকে রাখা যায় না, এটাই আশার জায়গা। তরুণদের সবার চোখ তো তারা অন্ধ করে দিতে পারেনি। আজকে এই আন্দোলন সংগঠিত করা ও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তরুণরা বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। আরও বেশি মাত্রায় জনগণের কাছে পৌঁছানো, তাদের সজাগ করা ও সংগ্রামের পথে ঐক্যবদ্ধ করাটাই আমাদের বিজয়ের মূল শর্ত। জনযাত্রা সেই কাজটাকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে। এখন আমরা আরও জোর গলায় বলতে পারি, সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে দেয়া হবে না। দেশ ও মানুষ ধ্বংসের এই ষড়যন্ত্র আমরা থামাবই। কারণ মহাপ্রাণ সুন্দরবন বিপর্যস্ত হলে পুরো বাংলাদেশই অরক্ষিত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশকে রক্ষা করতেই সুন্দরবন বাঁচাতে হবে, তার জন্য সুন্দরবিনাশী সকল প্রকল্প এবং অপতৎপরতা বন্ধ করতেই হবে।
http://www.shaptahik.com/v2/?
No comments:
Post a Comment