Saturday, March 26, 2016

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ

মুনতাসীর মামুন
"... আজ কুড়ি বছর পর স্পষ্ট-অস্পষ্ট স্বপ্নগুলোর কথা মনে হয়। ফিরে এলেন শেখ মুজিব। সবাই তার পিছে কাতারবন্দী। আর কোনো দেশে কোনো মানুষ এতোটা ভালোবাসা পেয়েছিলেন কিনা জানি না। আর কোনো দেশে কোনো মানুষ সাড়ে সাত কোটি লোককে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন কিনা তাও জানি না। শেখ মুজিব যখন ফিরে এসেছিলেন, সাধারণ মানূষ তেমন কিছু চাননি তার কাছে। এমনকি আওয়ামী লীগ শাসন শুরু করলেও বৈধতা নিয়ে জোরালো কোনো প্রশ্ন কেউ উঠায়নি।
কিন্তু সে সময়ই স্বপ্নগুলো গুঁড়িয়ে যেতে লাগলো। শাসকদের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন না তাদের অবস্থা কেমন ছিল? সম্পদ, কর্তৃত্বের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের মনে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, আমরা জানি তখন কি উদ্ধত ব্যবহার করেছিল ছাত্রলীগ। যেমন, আমার বিধবা ফুপুর জমির এক টুকরো লিখে দিতে হয়েছিল এক যুবনেতাকে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনুনয় করেও কোন ফলোদয় হয়নি।
এ প্রসঙ্গে একথাও বলা দরকার - সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে আমলের শেখ মুজিবের সরকারের কৃতিত্বকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমরা হয়েছিলাম অপমানিত। সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিই । তাদের সঙ্গে, যে কথা আগেই বলেছি, কেউ ছিল না, এখনও নেই। এই আমরা কারা? রণজিৎ গুহের ভাষায় বলতে হয়, যারা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত নন, ক্ষমতার বিন্যাস: অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক/প্রশাসনিক মতাদর্শগত দিকের সঙ্গে যারা যুক্ত নন - তারা।
১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আভাব, অনটন, অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা সবই ছিল। কিন্তু এসবের মধ্যেও তীব্র হয়ে বেজেছিল যেটি, সেটি হচ্ছে, নতুন এক অপমান। হঠাৎ দেখি সাড়ে সাত কোটির মধ্যে এক লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। বাকি সব? কেউ বলেনি তেমন করে; কিন্তু এক ধরণের হীনমন্যতাবোধ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল আমাদের মধ্যে, যারা ছিলাম দেশের মধ্যে। নিমিষেই একথা সবাই বিস্মৃত হলো যে, আমরা না থাকলে গেরিলারা থাকতো না। বিষয়টি আরো বেদনাদায়ক হয়ে উঠলো যখন দেখা গেল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সনদপত্র, বিশেষ পুরুষ্কার (তা যে ফর্মেই হোক) বরাদ্দ হচ্ছে। সাত কোটি মানুষ কেমন যেন অপাংক্তেয় হয়ে গেল মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কাছে। এরপর বাকশাল। এর দোষগুণ নিয়ে বিতর্কের অনেক কিছু হয়ত থাকতে পারে; কিন্তু একটি কথা সবার তখন মনে হয়েছিল - যে গণতন্ত্রের জন্য এতো রক্ত তা যেন হঠাৎ করে বৃথা হয়ে গেল।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিকা-ফলাফল নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। দুর্ভিক্ষ, রক্ষীবাহিনী নিয়ে অতিরঞ্জন হয়েছে অনেক, কিন্তু এর মধ্যে সত্যও যে ছিল তাতো অস্বীকার করার উপায় নেই। শুধু তাই নয়, যারা খুন করেছিল আমাদের বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনদের, তাদের অধিকাংশ মুক্তি পেতে লাগলো, এক সময় সবাই ক্ষমাও পেয়ে গেল। অথচ অনেক বিধবা, এতিমের কান্না শুকোয়নি তখনও। এর কারণ কি এই যে যারা শাসক ছিলেন তাদের সন্তান-সন্ততি বা আত্মীয়স্বজনদের প্রায় কোনো ক্ষতি হয় নি তখন?
আমরা তখন তেমন কিছু চাইনি। কিন্তু এগুলো ঘটেছিল। এগুলো ছিল এক ধরণের অপমান - যার জ্বালা মোটামুটি বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে ক্ষুধার জ্বালা থেকে কম নয়। এ মন্তব্য একপেশে, একরৈখিক শোনাবে। আমি জানি মানুষের বঞ্চনার বিষয়টি আরো বড়; তত্ত্বের সঙ্গে তা জড়িত। আমার এ হালকা ফ্রেমওয়ার্কে বিষয়টি আসছে না। কিন্তু সাধারণ মানূষ মিছিলে যায় প্রত্যক্ষ কোনো ঘটনার অভিঘাতে। সেখানে বুদ্ধি থেকে আবেগ কাজ করে বেশি। একথা কি সত্যি নয় যে ১৯৫২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত যে অগণিত মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন তাদের সবাই ছিলেন অতি সাধারণ মানুষ। তারা কি জানতেন না যে নেতারা কখনও প্রাণ দেন না এবং কথাও রাখেন না। তবুও তো তারা গেছেন এবং প্রাণ দিয়েছেন। কারণ, প্রত্যক্ষ কোনো ঘটনা তাকে উজ্জীবিত করেছে, খুলে দিয়েছে তার ঢেকে রাখা ক্রোধ প্রকাশ্যে।
আওয়ামী লীগ শাসনের অভিঘাত এখনও লোকে ভুলতে পারেনি দুটি কারণে। প্রথমত, তখন সদ্য স্বাধীন দেশ, মানুষ দেশের জন্য কিছু করার জন্য পাগল। অধিকাংশ মানুষের তখন সোনার বাংলা গড়ার আকাঙ্খা। ফলে ছোট কোন ঘটনা, ছোট কোনো ভুল বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল মানূষের মনে। রটনা হয়েছে যথেষ্ট; কিন্তু আওয়ামী লীগ তা মোকাবেলা করতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের ছিল দেশজোড়া সংগঠন - তৃণমূল পর্যায়ে। ফলে মাস্তানি বলি আর কর্তৃত্বের অপব্যবহারের কথা বলি, তা পৌঁছেছিল গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত। যদি তা না-ই হয় তাহলে মানুষ কেন নামেনি রাস্তায় স্বত:স্ফূর্তভাবে যেদিন সপরিবারে নিহত হলেন শেখ মুজিব? এ হত্যাকান্ড তো একমাত্র তুলনীয় হতে পারে হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে।
এভাবে সোনার বাংলার স্বপ্নের উপাদান - ছোট বাড়ি, দুটো কাপড়, দু'বেলা খাওয়া, রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম, খাকিদের হাত থেকে নিষ্কৃতি, রাষ্ট্রের অকথ্য জুলুম বন্ধ - সবই যেনো আবার ফিকে হয়ে যেতে লাগলো॥"
- মুনতাসীর মামুন / ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষমতায় থাকা ॥ [ আগামী প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩ । পৃ: ৮২-৮৪ ]
https://www.facebook.com/kai.kaus.31/posts/207615362937413

No comments:

Post a Comment