No means NO!
সিনেমার সিনটা মনে পড়ে গেলো... নায়িকা মুখ বেঁকিয়ে হাঁটছেন, যথেষ্ট বিরক্ত তিনি, অথচ কিছুতেই পিছন ছাড়ছে না কলার তোলা নায়ক, জোর করে ওড়না ধরে টান মারছে আর হল ভর্তি দর্শক ফেটে পড়ছে সোল্লাসে, আনন্দে... অনেকদিন থেকে, তা প্রায় বাচ্চা বয়েস থেকে শুনে আসছি “মেয়েদের না মানে হ্যাঁ”... সেই থিওরিতে খাড়া হয়ে আছে পুরুষতন্ত্রের জোর, তার চাপিয়ে দেওয়ার অভ্যেস... অধিকার বোধের ভিত্তি এবং শেষমেশ অ্যাসিড মারা কিংবা ধর্ষণ করা বা নিদেন পক্ষে যৌন হেনস্থা করার ছাড়পত্র। খুচরো আলাপ থেকে গায়ে হাত দেওয়াটা তাই পৌরুষের জলভাত প্রকাশ। ‘সত্যিই তো মেয়েটি যখন সিনেমা দেখতে গিয়েছিলো লাফাতে লাফাতে, মনে ছিল না যে সিনেমা হলের অন্ধকারে সঙ্গীর হাতটা অনায়াসে সুড়সুড়ি দিতে পারে শরীরের গোপন অঙ্গে!’... এই এক লজিকেই বাজি মাত। একসাথে সিনেমা দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে এই লজিকের মারপ্যাঁচে গুলিয়ে গিয়ে হয়ে গেলো বুকে হাত দেওয়ার ‘সম্মতি’। কি সরল সমীকরণ না! যার দুটো দিক সম্পূর্ণ অসমান, তবুও কি এক অদ্ভুত পিতৃতান্ত্রিক থিওরির ভারে ‘না’ এর ইচ্ছেটা জোরের সাথে ‘হ্যাঁ’ হয়ে যায়, সম্মতি পেয়ে যায় সমস্ত অনধিকার চর্চা ও অনুপ্রবেশ। আসলে এই কনসেন্ট বা সম্মতি ব্যাপারটা বেশ অস্পষ্ট কারণ আমরা আগাগোড়া ধরে নিই এর একটা স্থূল এবং গাঁট অবস্থান ও অর্থ যেন কোন একটি ‘সম্মতি’ স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে একই থাকবে। আর এই ভাবনাতেই অজান্তে বৈধতা পেয়ে যায় অসম্মত অনেক আচরণ। মানে ধরুন আমার সাথে কোন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির প্রাথমিক আলাপ হল, আমি তার সাথে নন্দনে আইসক্রিম খেতে গেলাম... এখন উনি মনে করলেন আইসক্রিম খেয়েছি মানে ওনার সাথে আমার একবার বাঞ্জি ঝাম্পিং করা উচিৎ... উদ্ভট লাগলো কি না শুনে! লাগতেই পারে, কিন্তু এখন শব্দবন্ধটা বাঞ্জি ঝাম্পিং এর বদলে কেউ একটা (বা সমাজের একাংশ) বসিয়ে দিল ‘একটু ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়’... তাহলেই অদ্ভুতভাবে ওপরের বাক্যটি সমাজের চোখে মান্যতা পেয়ে যায়। সেখানে আমার বা ওরকম একটি অবস্থায় থাকা একজন মানুষের ঘনিষ্ঠ হওয়ার ‘সম্মতি’র তোয়াক্কা জাস্ট করা হয় না এবং সেই আচরণটি বিধিসম্মত। ঠিক যেভাবে বিয়ের পরে ধর্ষণ বিধিসম্মত, সেখানেও তো একজন মেয়ে বিয়েটা সম্মতিক্রমেই করে এবং একটিবার ‘সমর্পণের’ সম্মতি(!) কে এই সমাজ সারাজীবন ভর যৌনদাসীবৃত্তির সম্মতি হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। যেমন করে গতকাল একাবলীর পোস্টটা ফেসবুকে হাজার খানেক শেয়ার পাওয়ার পর যখন একের পর এক মেয়ে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলছেন ঠিক তখনই একটা উল্টো বক্তব্যের চোরা স্রোত ভেসে আসছে যে ‘অচেনা কারও সাথে চ্যাট করেছিলো কেন?’ বা ‘প্রথমবার ডেটিং এ গিয়েছিলো কেন?’... এ এক অদ্ভুত অবস্থান, যেন কথা বলার সম্মতি কারোর কাছে জোর করে যৌন হেনস্থা বা ভারবাল অ্যাবিউসের সম্মতি আদায় করার সমান। বহু মানুষই এই উপরিউক্ত লজিকের মারপ্যাঁচে হারিয়ে ফেলছেন একজন মানুষের স্বাতন্ত্র্যকে, তার সম্মতি প্রদানের গণ্ডীটি উপেক্ষিত হয়ে যাচ্ছে এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পড়ে। আসুন আরও গভীরে ভাবি... ওপরের লজিকটি মান্যতা পেলে আসলে আস্তে আস্তে আমরা আবার পর্দানসীনতার লজিকে ফিরে যাবো না তো! যেমন ‘মেয়েটি কথা কেন বলেছিল, তাই হেনস্থার শিকার হল’ থেকে পৌঁছে যাবো ‘মেয়েটি রাস্তায় কেন বেরিয়েছিল, তাই তো ধর্ষিতা হতে হল’! যাই হোক মোদ্দা যা বলার, প্রচলিত ধাঁধায় পড়ার আগে লজিক তৈরীর পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর ঘুনপোকাগুলো বাছাই করার প্রয়োজন মনে হচ্ছে সবার আগে।
No comments:
Post a Comment