সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বাংলাদেশ
তিনি চলে গেলেন - বন্ধু স্যালুট
'সেনাসদস্যরা যখন গুলি করতে করতে এগোয়, তখন ১৫ থেকে ২০ জন বাঙালি যুবক প্রায় ২০০ গজ দূরে তাদের মুখোমুখি হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু মনে হলো তারা নিরস্ত্র, খালি হাত। জিপের উপরের মেশিনগান ঘুরিয়ে ধরল তাদের দিকে, এরপর চলল গুলি। স্বয়ংক্রিয় রাইফেলধারী সৈন্যরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিল। যুবকরা রাস্তার দুই পাশে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ নিহত কিংবা আহত হয়েছে কিনা এখান থেকে বোঝা মুশকিল'।
'কোথাও শোনা যাচ্ছে চিৎকার ‘হায় আল্লাহ, হায় আল্লাহ, ওরা তাদের মেরে ফেলছে, ওরা তাদের জবাই করছে।’
সিডনি শনবার্গ ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থেকে শুনছিলেন, দেখছিলেন শহরের বিভিন্ন অংশে আগুনের লেলিহান শিখা । ভয়াবহ আগুন জ্বলছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। প্যারামিলিটারি ফোর্স পূর্ব পাকি স্তান রাইফেলসে আগুন জ্বলছে। গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে।
‘অপারেশন সার্চ লাইট’ র মাধ্যমে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক কর্তৃক এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম ও নির্বিচার গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ‘নিউইয়র্ক টাইমসের’ সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ একাত্তরের পঁচিশ এ কালোরাত ঢাকায় অবস্থানের অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীকে এভাবেই জানিয়ে ছিলেন ‘৭৫ মিলিয়ন মানুষের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে স্বায়ত্ত শাসনের আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে পাকি স্তানি বাহিনীর কামান ও ভারী মেশিনগান ব্যবহার ।
তিনি লিখেছেন, নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর ত্রাণ সহায়তার জন্য সৌদি আরব পাকিস্তানকে চারটি হেলিকপ্টার দিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই হেলিকপ্টার পূর্ব পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে ব্যবহার করা হচ্ছে।
২৫ মার্চের গণহত্যার সূচনা তিনি প্রত্যক্ষ করেছে ঢাকায় থেকে, বহিষ্কৃত হয়েছেন অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কৃত হলেও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে সরে যাননি। কখনো মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঢুকে পড়েছেন মুক্তাঞ্চলে, প্রত্যক্ষ করেছে যুদ্ধ অপারেশন, ঘুরেছেন শরণার্থী শিবিরে। জুন মাসে মুষ্টিমেয় যেসব সাংবাদিককে ঢাকা আসার অনুমতি দিয়েছিল সামরিক সরকার, তাঁদেরও অন্যতম ছিলেন শনবার্গ।
মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের আগেই আগরতলায় সরকার গঠিত হওয়ার সংবাদ প্রথম তিনি প্রকাশ করেন। খালেদ মোশাররফের গেরিলা দলের সঙ্গে তাদের অপারেশনে দেশের ভেতরে তিনি প্রবেশ করেন। জুন মাসে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ নিয়মকানুন শিথিল করে বিদেশি সংবাদদাতাদের ঢাকায় আসার অনুমোদন দিলে সিডনি শনবার্গ সেই সুযোগ গ্রহণ করেন বটে, তবে তাঁর রিপোর্ট কর্তৃপক্ষের মনঃপূত না হওয়ায় অচিরেই আবার বহিষ্কৃত হন।
সিডনি শনবার্গের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ জানাশোনা ছিল। পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো যখন বঙ্গবন্ধু আসছেন, পথে দিল্লিতে থেমেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যখন তিনি হেঁটে সামনের দিকে যাচ্ছেন, পৃথিবীর সব নামকরা সাংবাদিকরা পথের দু’ধারে লাইন করে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই ভিড় থেকে বঙ্গবন্ধু সিডনি শনবার্গকে চিনতে পারেন এবং তার কাছে এসে তার সঙ্গে কোলাকুলি করেন। ছোট্ট দু’একটা কথার আদান-প্রদান ঘটে এরই মধ্যে।
ঢাকাতেও স্বাধীনতার আগে-পরে বেশ কয়েকবার সিডনি শনবার্গের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখা হয় কথা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকে শনবার্গ উপমহাদেশের সবচেয়ে কলঙ্কময় ঘটনা বলে মনে করতেন ।
ঢাকাতেও স্বাধীনতার আগে-পরে বেশ কয়েকবার সিডনি শনবার্গের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখা হয় কথা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকে শনবার্গ উপমহাদেশের সবচেয়ে কলঙ্কময় ঘটনা বলে মনে করতেন ।
একাত্তরে সংঘটিত নৃশংসতা ও বর্বরতাকে দুই ভাগে দেখা হয়, সংগঠিত ও ব্যাপকভাবে যেসব হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন ঘটেছে, তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং সুনির্দিষ্টভাবে কোনো জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে গোষ্ঠীর সদস্যদের পুরোপুরি বা আংশিকভাবে উৎখাত বা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে, তা জেনোসাইড হিসেবে বিবেচিত ।
হিন্দু জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করার লক্ষ্য নিয়ে আদৌ কি পরিচালিত হয়েছিল জেনোসাইড—এই নিয়ে সাক্ষ্যভাষ্য হিসেবে বিদেশি সংবাদদাতাদের রিপোর্ট পালন করে বিশাল ভূমিকা। এ ক্ষেত্রে সিডনি শনবার্গের রিপোর্ট থেকে । জুন মাসে ঢাকায় এসে সরেজমিনে বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে তিনি কয়েকটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন।
২৫ জুন, ১৯৭১ প্রকাশিত রিপোর্টে লিখেছিলেন: ‘হিন্দু সংখ্যালঘিষ্ঠরা বিশেষভাবে সেনা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যে ছয় লাখ পূর্ব পাকিস্তানি ভারতে পালিয়ে গেছে, তাদের ভেতর চার লাখ বা ততোধিক হচ্ছে হিন্দু। হিন্দু অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান যারাই পালিয়ে গেছে, তাদের বাড়িঘর দিয়ে দেওয়া হচ্ছে “অনুগত” নাগরিকদের।’
সিডনি শনবার্গ সে-যাত্রায় ফরিদপুরে গিয়েছিলেন এবং ২৯ জুন, ১৯৭১ প্রকাশিত রিপোর্টে লেখেন, ‘সংঘর্ষক্ষেত্রে কর্মরত একজন আর্মি কমান্ডার ব্যক্তিগত আলাপ চারিতার সময় স্বীকার করেন, তাঁদের নীতি হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংস করা, হিন্দু ও মুসলমান উভয়কে, বিশেষভাবে হিন্দুদের, উৎখাত করা।
ফরিদপুরে এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় গোটা পরিধিজুড়েই, সেনাবাহিনী আসার আগে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। আর্মি এখন এমন বিরোধ উসকে দিতে চাইছে। এপ্রিল মাসে জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ফরিদপুর শহরকেন্দ্রে দুজন হিন্দুর শিরশ্ছেদ করে তাঁদের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকজন হিন্দু যখন প্রাণ বাঁচাতে ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে আবেদন জানায়, তাদের কাফের গণ্য করে গুলি করে মারা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য ধর্মান্তরিত হওয়া গৃহীত হয়ে থাকে।’
এই রিপোর্ট প্রকাশের পর পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ সিডনি শনবার্গকে পুনরায় বহি ষ্কার করে। সিডনি শনবার্গ এরপর ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ট্যাংকে সওয়ারি হয়ে, তাঁকে বহিষ্কারের ক্ষমতা যখন আর পাকিস্তান বাহিনীর ছিল না। ৪০ বছর পর সত্যের সওয়ারি হয়ে সিডনি শনবার্গের রিপোর্ট আবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কক্ষে এবং কক্ষের বাইরে।
সিডনি শনবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট সম্পন্ন করে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়ে ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমস-এ। কপি বয়, ডেস্ক রাইটার ইত্যাদি নানা কাজে যোগ্যতার পরি চয় দিয়ে ১৯৭১ সালে তিনি পত্রিকার দিল্লি অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তরুণ এই সাংবা দিকের জন্য বাংলাদেশ বিষয়ক রিপোর্টিং ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ। পরবর্তী জীবনে শনবার্গ টাইমস ছেড়ে তিনি নিউইয়র্ক শহরের আরেকটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা দৈনিক নিউইয়র্ক নিউজ ডে-তে যোগ ছিলেন ।
একাত্তরে আমেরিকার মধ্যে নিউইয়র্ক টাইমসে সবচেয়ে বেশি খবর থাকত বাংলাদেশের। সিডনি শনবার্গ প্রথম দিন থেকেই বড় বড় সব প্রতিবেদন দিতেন নিউইয়র্ক টাইমসে, তাতে থাকতো পাকিস্তানিদের পৈশাচিকতার আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিক অপারেশনের বিস্তারিত । সিডনি শনবার্গ ও বিদেশি সংবাদদাতাদের অধিকাংশ রিপোর্ট মার্কিন কংগ্রেশনাল রেকর্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এডওয়ার্ড কেনেডি ও অন্য কংগ্রেস সদস্যদের বক্তব্যের সুবাদে। এই সব দলিল ইতিহাসের অন্তর্গত, রিপোর্টগুলো আমাদের মুক্তি যুদ্ধের এক অসাধারণ প্রামাণ্য দলিল।
তথ্যসূত্র : নেট, পত্রিকা, ডেটলাইন বাংলাদেশ : নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান, সিডনি শনবার্গ, মফিদুল হক অনূদিত, সিডনি শনবার্গ: একাত্তরের ভাষ্য জেনোসাইডের সাক্ষ্য = মফিদুল হক, প্রবাসে একাত্তরে, পূরবী বসু
No comments:
Post a Comment