গণধর্ষিতা কাশ্মীরঃ আমাদের চাই পূর্ণ আকাশ
অর্ধেক আকাশ
নির্ভয়ার কথা মনে পড়ে? কয়েকজন মিলে তছনছ করেছিল যে মেয়েটির যোনি, স্তন, শরীর! অনেকের মতো আমি-আপনিও ঘৃণায়, যন্ত্রণায় পথে নেমেছিলাম সেদিন। এর পরে যখনই ধর্ষণ হয়েছে এই রাজ্যের কামদুনি-কাকদ্বীপ-মধ্যমগ্রামে... আমরা ফের সোচ্চার হয়েছি। চুপ করে থাকতে পারি নি। কারণ, ধর্ষণের মতো... যৌন-হিংসার মতো নৃশংস ক্ষমতার আস্ফালন দেখে চুপ থাকা যায় না। কারণ আমরা সংবেদনশীল। তাই হয়ত তন্ন তন্ন করে খুঁজতে চেয়েছি ধর্ষণের আসল কারণ ঠিক কী? খুঁজতে চেয়েছি মুক্তির পথ। কেউ চেয়েছি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, কেউ চেয়েছি আরও আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা। চেয়েছি রাষ্ট্র নারীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করুক। দরকারে পুলিশকে কাজে লাগানো হোক, আর্মিকেও।
মনে পড়ে থাংজাম মনোরমার কথা? মণিপুরের সেই নিরস্ত্র সাধারণ মেয়েটি, যাকে গণধর্ষণ ক’রে প্রমাণ লোপাটের জন্য বুলেট দিয়ে যোনি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। মণিপুরে ‘AFSPA (Armed Forces Special Power Act)’ জারী! সেনাবাহিনীর ইচ্ছে বা অধিকারে বাধা দিতে পারবে না কেউ। এত সেনা দিয়ে ঘেরা এত ‘নিরাপদ’ মণিপুরে কেন তবে ধর্ষিতা হতে হয় মনোরমাদের? আমরা কি জানি এই প্রশ্নের উত্তর?
কিংবা ‘ভূস্বর্গ’ কাশ্মীর। প্রকৃতি সর্বস্ব সুন্দর নিয়ে উজাড় যেখানে, সেই উপত্যকা থেকে গুলির শব্দ, হাহাকারের শব্দ এতদূর এসে পৌঁছোয় না। সেখানে মেয়েদের মূলত চারটি পরিচয়--- ধর্ষিতা, বিধবা, আধা-বিধবা আর ‘yet to be raped’!
এই কাশ্মীরেই কুপওয়ারা জেলার কুনান-পোশপোরায় ১৯৯১ সালের এক হিম-কনকনে শীতের রাতে ‘জ্যোৎস্নাভিসারে’ বেরিয়েছিল ভারতীয় সেনার রাজপুতানা রাইফেলস-এর জওয়ানরা। তল্লাশির নামে গণধর্ষণের সেই নারকীয় উৎসবে ছাড় পাননি এই দুই গ্রামের সাত থেকে সত্তর প্রায় কোনও মহিলাই। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেছে, আইনি লড়াই চালিয়ে আজও সামান্য বিচার পাননি সেদিনের ধর্ষিতারা।
যদি এই হয় রাষ্ট্র-নিরাপত্তা-বিচারের আসল চেহারা, তবে কিসের ওপর আস্থা রাখি আপনি-আমি? কাশ্মীরেও কিন্তু ‘AFSPA’ জারী! জারী এরকম আরও অনেক কিছুই।
ধনঞ্জয়ের শাস্তি হয়, নির্ভয়ার ধর্ষকদেরও শাস্তি হয়, কিন্তু গত আড়াই-তিন দশক ধরে প্রায় প্রতিদিন কাশ্মীরে ঘটে চলা সরকারীভাবে নথিভুক্ত বা অ-নথিভুক্ত একটা ধর্ষণও প্রমাণ করা যায় না। হাজারে হাজারে পথে নেমে আমরাও ঝড় তুলি না প্রতিবাদের! তবে কি ‘কাশ্মীর’ নিয়ে কোনো অদৃশ্য বাধা ভেতর থেকে কাজ করে যায় আমাদের মধ্যে?
যুদ্ধ নিয়ে একটা যুক্তি চালু আছে। বিশেষত ‘ন্যায়যুদ্ধ’ নিয়ে। সেই মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শুনিয়েছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবত গীতা! ধর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অগণিত সাধারণ মানুষকে নাকি প্রাণ দিতে হবে! আমেরিকার ভাষায় ‘কো-ল্যাটেরাল ড্যামেজ’। এভাবেই ‘ন্যায়’ প্রতিষ্ঠার জন্য ৫০ বছর আগে হাজার হাজার ভিয়েতনামীকে এবং গত ৫০ বছর ধরে দেশে দেশে কোটি কোটি নারী-শিশু-আমজনতাকে ধ্বস্ত করেছে আমেরিকা বোমা-গুলি-বেয়নেট-শিশ্নের আঘাতে। এভাবেই ঐসলামিক পৃথিবী গড়ার নাম করে নির্বিচারে ধর্ষিত-নিহত হতে হয়েছে নিরপরাধ নরনারীকে ঐসলামিক সন্ত্রাসীদের হাতে। এই ‘পবিত্র ন্যায়যুদ্ধ’-এর যুক্তিতেই গোধরা কান্ডের পর গুজরাটে গর্ভবতী মুসলিম রমণীর পেট চিরে বার করা ভ্রূণ ত্রিশূলের ফলায় গেঁথে উল্লাসনৃত্য করেছে হিন্দুরাষ্ট্রের ধ্বজাধারী গেরুয়া সন্ত্রাসীরা।
তাই কাশ্মীরে একটা যুদ্ধ চলছে... ভারতীয় আর্মির সাথে জঙ্গীদের... এই যুক্তিতে যদি আপনি-আমি কুনান পোশপোরার গণধর্ষণ কান্ডের ২৫ বছর পূর্তিতে আজ লজ্জায় মাথা হেঁট না করি, তবে এযাবৎ কাল পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে ঘটে যাওয়া সব ক’টা গণহত্যা বা গণধর্ষণেরই সমর্থক হয়ে যেতে হয় আমাদেরকে!
অন্যায় যুদ্ধের কারবারীরা... সে ভারতের শাসকশ্রেণী হোক বা পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী... মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হোক বা ঐসলামিক সন্ত্রাসী... গেরুয়া ফ্যাসিস্ট হোক বা মানবতা-বিরোধী জঙ্গী... সকলেই নিজের-চালানো যুদ্ধকে ‘ন্যায়যুদ্ধ’ বলে। ধর্ষণ-শ্লীলতাহানী-যৌনদাসী ক’রে সম্ভোগ সে যুদ্ধে যৌন নির্যাতন নয়, যুদ্ধাস্ত্র। শিশ্ন আর রাইফেল সেখানে একই। আর এই অন্যায় যুদ্ধে মনে মনে একবার যদি জড়িয়ে পড়ি আমরা...পক্ষ নিয়ে ফেলি, তবে আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যাবে সেই আসল যুদ্ধ, যে যুদ্ধ লড়ে চলেছেন সাধারণ কাশ্মীরী মানুষেরা... খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয়-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কাজ পাওয়ার যুদ্ধ... যে যুদ্ধ আমার-আপনারও। এই আসল যুদ্ধের শরিক আমরা যদি মনে মনেও হতে পারি, তবে কেন কাশ্মীরী মহিলাদের বিয়ের গানেও আজ জড়িয়ে যায় স্বামীর অতর্কিত মৃত্যু-আশঙ্কা, কেন হাজার হাজার নিখোঁজ সন্তানের খোঁজ পেতেই শুধু আলাদা সংগঠন গড়ে তুলতে হয় কাশ্মীরী মা-বাবাদের, তা হয়তো আমাদের অন্তরাত্মাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে।
আর কে না জানে, ইতিহাসে যুদ্ধের ভেট হিসেবে নারী-শরীর ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ বা কবিতা লেখার চেয়ে নিজের দেশের মিলিটারী-কর্তৃক দেশবাসীরই একাংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা ও আফস্পা-কার্ফু-ত্রাস-লুঠ-ধর্ষণ দিয়ে দখল বজায় রাখার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া অনেক কঠিন কাজ!
যারা বলছেন “কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ”, তারা ‘কাশ্মীর’ বলতে কি বোঝাচ্ছেন? যদি ‘কাশ্মীর’ মানে হয় কাশ্মীরের মানুষ, তবে দিনের পর দিন বছরের পর বছর তাদেরকে নির্বিচার লুন্ঠন-ধর্ষণ-হত্যাকে আমরা সমর্থন করবো কীভাবে? কাশ্মীরের বেশিরভাগ স্বাধীনতাকামী মানুষকে মেরে ফেলে পড়ে থাকে যে কাশ্মীর, সেই জনমানবশূন্য রক্তময় শ্মশানপুরী দখল ক’রে ভারতের শাসকদের লাভ হতে পারে, পাকিস্তানের শাসকদের তা নিয়ে লোভে লালা ঝরতে পারে, আমি-আপনি কি ক’রে তাদের মধ্যে কোনো একটার পাশে দাঁড়াই? ভারতবর্ষের যে শাসকশ্রেণী প্রতিদিন শোষণ-লুন্ঠন করে চলেছে আপামর ভারতবাসীকে, সেই শাসকশ্রেণীর অজুহাতগুলি কি ক’রে হয়ে উঠতে পারে আমাদের...অর্থাৎ আপামর ভারতবাসীর...যুক্তি?
আসলে আমাদের মনের মধ্যেও একটা ‘রাষ্ট্র’ বেঁচে-বর্তে থাকে; যে ‘রাষ্ট্র’ বাইরের রাষ্ট্র’টার মতোই ধনিকপ্রেমী, পিতৃতান্ত্রিক, দমনমূলক। সুযোগ পেলেই সে অন্যের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়। একদিকে আমরা যৌন-হিংসা থেকে মুক্তি চাই। এমন এক সমাজ চাই যেখানে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ থাকবে না...যেখানে মেয়েরা ‘মেয়ে’ নয়, মানবী। অন্যদিকে মনের মধ্যে গেড়ে-বসে-থাকা ‘রাষ্ট্র’টি কিন্তু ঐ ইচ্ছে’র বিরুদ্ধে কাজ করে। সমাজের ওপর চেপে-বসে-থাকা রাষ্ট্রটি যেমন পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ-প্রভুত্ব-সহায়ক, মনের মধ্যেও ঠিক তাই। হাজার হাজার বছর ধরে এগিয়ে-চলা সমাজে যেমন এই পিতৃতন্ত্রের বিরোধী আদর্শগুলি তৈরি হয়েছে, তেমনি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রূপ বদলে বদলে রয়ে গেছে পিতৃতন্ত্র টিকে থাকার পক্ষের আদর্শগুলিও।
কে না জানে জনবিরোধী ক্ষমতার ভাষা যুগে যুগে একই! তাই পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ যেমন ক্ষমতাকাঠামোকে রসদ দেয়, তেমনই অন্যায়-আধিপত্যের সহায়ক অন্য সব আদর্শই ঐ ক্ষমতাকাঠামোর পুঁজি। তাই সব আধিপত্য ও বৈষম্য-বিরোধী লড়াই কোথাও না কোথাও এক সুতোয় বাঁধা থাকে।
সেই সুতোর টানেই হয়তো যে কাশ্মীরী নারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর লাঠি-গুলি-শিশ্নের উল্টো দিকে ছুঁড়ে দেন থুথু কিম্বা পাথর, সেই একই নারী বোরখার অন্তরালে পর্দানসীন করার ওয়াহাব-সংকীর্ণতা ছিঁড়ে ফেলে মনে করিয়ে দেন সুফী উদারতার ঐতিহাসিক পীঠস্থান কাশ্মীরকে। শুধু সংখ্যা বাড়াতে নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে শান্তির জন্য যুদ্ধের সামনের সারিতে যখন ক্রমশ হাজারে হাজারে পৃথিবীজুড়ে পথে নামছেন মেয়েরা, তখন রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যের ‘পুরুষ’-মুখের বিপরীতে প্রতিস্পর্ধী ‘নারী’বোধের নিরন্তর নির্মাণ ঘটিয়ে-চলা প্রতিবাদী কাশ্মীরী মেয়েরা যে ঐ একই সারির যোদ্ধা, তা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না আমাদের।
এই মুক্তিকামী লড়াকু কাশ্মীর থেকেই কলকাতায় আসছেন নাতাশা রাঠের ও ইফ্রা বাট। ২৫ বছর আগের সেই কলঙ্কময় সেনা অভিযানকে স্মরণ ক’রে প্রকাশিত হয়েছে ৫ জন অসমসাহসিনী প্রতিবাদী নারীর লেখা বই “ডু ইউ রিমেম্বার কুনান পোশপোরা”। নাতাশা ও ইফ্রা ঐ ৫ জন সংগ্রামী লেখিকার মধ্যে অন্যতম ২ জন।
আগামী ১২ই জুলাই (মঙ্গলবার), বিকেল ৪-টেয় মধ্য-কলকাতার ভারত সভা হল-এ আমাদের আয়োজিত আলোচনাসভায় মূলত নাতাশা আর ইফ্রা’র থেকেই আমরা শুনবো গত ২৫ বছর জুড়ে কাশ্মীরী মেয়েদের লড়াইয়ের কথা, লাঞ্ছনা-ধর্ষণ-মৃত্যুর অগণিত মিছিল পেরিয়েও নিরন্তর বহমান মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিভাষ্য।
কথোপকথনে থাকবেন জয়া মিত্র, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অগ্নিগর্ভ সত্তর দশকের অগ্নিকন্যারা, বলবেন ছত্তিশগড়ে গত চার দশক জুড়ে চলা শ্রমিক আন্দোলন-প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম-সহ ভারত জোড়া মানবাধিকার আন্দোলনের পরিচিত মুখ ঈলিনা সেন, বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে মদের ভাঁটি-ভাঙ্গার লড়াইয়ের মুখ সামিমা খাতুন, হায়দ্রাবাদের প্রান্তিকায়িত যৌনতাভুক্ত দলিত মানুষদের সংগ্রামের প্রতিনিধি রচনা, অসংগঠিত শ্রমিকদের লড়াইয়ের মর্মবস্তু-অনুসন্ধানকারী গবেষিকা আলবিনা, আফস্পা-বিরোধী গণ-আন্দোলনের অন্যতম মুখ নিশা বিশ্বাস। নিজেদের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে মুক্তিকামী কাশ্মীরকে খুঁজে দেখবেন ওঁরা।
প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-প্রতিস্পর্ধার এই ভাষা ও ভাষ্যগুলি অভিন্ন নয়। আবার ভিন্নও নয়। বক্তাদের দেখা আর আমার-আপনার এতদিন-পর্যন্ত উপলব্ধি মিলতে পারে, নাও মিলতে পারে। ঐ দিন আমি-আপনিও তাই বলবো, প্রশ্ন করবো। সংলাপ-বৈচিত্র্যে সভা হোক অন্তর্ঘাতী। যৌন-হিংসার বিরুদ্ধে লিঙ্গ-সাম্যের জন্য নানা প্রান্তের লড়াইগুলো তবেই না স্বপ্নে স্বপ্নে মিলে যাবে স্বাধীনতার পূর্ণ আকাশে...
অর্ধেক আকাশ
নির্ভয়ার কথা মনে পড়ে? কয়েকজন মিলে তছনছ করেছিল যে মেয়েটির যোনি, স্তন, শরীর! অনেকের মতো আমি-আপনিও ঘৃণায়, যন্ত্রণায় পথে নেমেছিলাম সেদিন। এর পরে যখনই ধর্ষণ হয়েছে এই রাজ্যের কামদুনি-কাকদ্বীপ-মধ্যমগ্রামে... আমরা ফের সোচ্চার হয়েছি। চুপ করে থাকতে পারি নি। কারণ, ধর্ষণের মতো... যৌন-হিংসার মতো নৃশংস ক্ষমতার আস্ফালন দেখে চুপ থাকা যায় না। কারণ আমরা সংবেদনশীল। তাই হয়ত তন্ন তন্ন করে খুঁজতে চেয়েছি ধর্ষণের আসল কারণ ঠিক কী? খুঁজতে চেয়েছি মুক্তির পথ। কেউ চেয়েছি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, কেউ চেয়েছি আরও আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা। চেয়েছি রাষ্ট্র নারীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করুক। দরকারে পুলিশকে কাজে লাগানো হোক, আর্মিকেও।
মনে পড়ে থাংজাম মনোরমার কথা? মণিপুরের সেই নিরস্ত্র সাধারণ মেয়েটি, যাকে গণধর্ষণ ক’রে প্রমাণ লোপাটের জন্য বুলেট দিয়ে যোনি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। মণিপুরে ‘AFSPA (Armed Forces Special Power Act)’ জারী! সেনাবাহিনীর ইচ্ছে বা অধিকারে বাধা দিতে পারবে না কেউ। এত সেনা দিয়ে ঘেরা এত ‘নিরাপদ’ মণিপুরে কেন তবে ধর্ষিতা হতে হয় মনোরমাদের? আমরা কি জানি এই প্রশ্নের উত্তর?
কিংবা ‘ভূস্বর্গ’ কাশ্মীর। প্রকৃতি সর্বস্ব সুন্দর নিয়ে উজাড় যেখানে, সেই উপত্যকা থেকে গুলির শব্দ, হাহাকারের শব্দ এতদূর এসে পৌঁছোয় না। সেখানে মেয়েদের মূলত চারটি পরিচয়--- ধর্ষিতা, বিধবা, আধা-বিধবা আর ‘yet to be raped’!
এই কাশ্মীরেই কুপওয়ারা জেলার কুনান-পোশপোরায় ১৯৯১ সালের এক হিম-কনকনে শীতের রাতে ‘জ্যোৎস্নাভিসারে’ বেরিয়েছিল ভারতীয় সেনার রাজপুতানা রাইফেলস-এর জওয়ানরা। তল্লাশির নামে গণধর্ষণের সেই নারকীয় উৎসবে ছাড় পাননি এই দুই গ্রামের সাত থেকে সত্তর প্রায় কোনও মহিলাই। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেছে, আইনি লড়াই চালিয়ে আজও সামান্য বিচার পাননি সেদিনের ধর্ষিতারা।
যদি এই হয় রাষ্ট্র-নিরাপত্তা-বিচারের আসল চেহারা, তবে কিসের ওপর আস্থা রাখি আপনি-আমি? কাশ্মীরেও কিন্তু ‘AFSPA’ জারী! জারী এরকম আরও অনেক কিছুই।
ধনঞ্জয়ের শাস্তি হয়, নির্ভয়ার ধর্ষকদেরও শাস্তি হয়, কিন্তু গত আড়াই-তিন দশক ধরে প্রায় প্রতিদিন কাশ্মীরে ঘটে চলা সরকারীভাবে নথিভুক্ত বা অ-নথিভুক্ত একটা ধর্ষণও প্রমাণ করা যায় না। হাজারে হাজারে পথে নেমে আমরাও ঝড় তুলি না প্রতিবাদের! তবে কি ‘কাশ্মীর’ নিয়ে কোনো অদৃশ্য বাধা ভেতর থেকে কাজ করে যায় আমাদের মধ্যে?
যুদ্ধ নিয়ে একটা যুক্তি চালু আছে। বিশেষত ‘ন্যায়যুদ্ধ’ নিয়ে। সেই মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শুনিয়েছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবত গীতা! ধর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অগণিত সাধারণ মানুষকে নাকি প্রাণ দিতে হবে! আমেরিকার ভাষায় ‘কো-ল্যাটেরাল ড্যামেজ’। এভাবেই ‘ন্যায়’ প্রতিষ্ঠার জন্য ৫০ বছর আগে হাজার হাজার ভিয়েতনামীকে এবং গত ৫০ বছর ধরে দেশে দেশে কোটি কোটি নারী-শিশু-আমজনতাকে ধ্বস্ত করেছে আমেরিকা বোমা-গুলি-বেয়নেট-শিশ্নের আঘাতে। এভাবেই ঐসলামিক পৃথিবী গড়ার নাম করে নির্বিচারে ধর্ষিত-নিহত হতে হয়েছে নিরপরাধ নরনারীকে ঐসলামিক সন্ত্রাসীদের হাতে। এই ‘পবিত্র ন্যায়যুদ্ধ’-এর যুক্তিতেই গোধরা কান্ডের পর গুজরাটে গর্ভবতী মুসলিম রমণীর পেট চিরে বার করা ভ্রূণ ত্রিশূলের ফলায় গেঁথে উল্লাসনৃত্য করেছে হিন্দুরাষ্ট্রের ধ্বজাধারী গেরুয়া সন্ত্রাসীরা।
তাই কাশ্মীরে একটা যুদ্ধ চলছে... ভারতীয় আর্মির সাথে জঙ্গীদের... এই যুক্তিতে যদি আপনি-আমি কুনান পোশপোরার গণধর্ষণ কান্ডের ২৫ বছর পূর্তিতে আজ লজ্জায় মাথা হেঁট না করি, তবে এযাবৎ কাল পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে ঘটে যাওয়া সব ক’টা গণহত্যা বা গণধর্ষণেরই সমর্থক হয়ে যেতে হয় আমাদেরকে!
অন্যায় যুদ্ধের কারবারীরা... সে ভারতের শাসকশ্রেণী হোক বা পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী... মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হোক বা ঐসলামিক সন্ত্রাসী... গেরুয়া ফ্যাসিস্ট হোক বা মানবতা-বিরোধী জঙ্গী... সকলেই নিজের-চালানো যুদ্ধকে ‘ন্যায়যুদ্ধ’ বলে। ধর্ষণ-শ্লীলতাহানী-যৌনদাসী ক’রে সম্ভোগ সে যুদ্ধে যৌন নির্যাতন নয়, যুদ্ধাস্ত্র। শিশ্ন আর রাইফেল সেখানে একই। আর এই অন্যায় যুদ্ধে মনে মনে একবার যদি জড়িয়ে পড়ি আমরা...পক্ষ নিয়ে ফেলি, তবে আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যাবে সেই আসল যুদ্ধ, যে যুদ্ধ লড়ে চলেছেন সাধারণ কাশ্মীরী মানুষেরা... খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয়-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কাজ পাওয়ার যুদ্ধ... যে যুদ্ধ আমার-আপনারও। এই আসল যুদ্ধের শরিক আমরা যদি মনে মনেও হতে পারি, তবে কেন কাশ্মীরী মহিলাদের বিয়ের গানেও আজ জড়িয়ে যায় স্বামীর অতর্কিত মৃত্যু-আশঙ্কা, কেন হাজার হাজার নিখোঁজ সন্তানের খোঁজ পেতেই শুধু আলাদা সংগঠন গড়ে তুলতে হয় কাশ্মীরী মা-বাবাদের, তা হয়তো আমাদের অন্তরাত্মাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে।
আর কে না জানে, ইতিহাসে যুদ্ধের ভেট হিসেবে নারী-শরীর ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ বা কবিতা লেখার চেয়ে নিজের দেশের মিলিটারী-কর্তৃক দেশবাসীরই একাংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা ও আফস্পা-কার্ফু-ত্রাস-লুঠ-ধর্ষণ দিয়ে দখল বজায় রাখার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া অনেক কঠিন কাজ!
যারা বলছেন “কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ”, তারা ‘কাশ্মীর’ বলতে কি বোঝাচ্ছেন? যদি ‘কাশ্মীর’ মানে হয় কাশ্মীরের মানুষ, তবে দিনের পর দিন বছরের পর বছর তাদেরকে নির্বিচার লুন্ঠন-ধর্ষণ-হত্যাকে আমরা সমর্থন করবো কীভাবে? কাশ্মীরের বেশিরভাগ স্বাধীনতাকামী মানুষকে মেরে ফেলে পড়ে থাকে যে কাশ্মীর, সেই জনমানবশূন্য রক্তময় শ্মশানপুরী দখল ক’রে ভারতের শাসকদের লাভ হতে পারে, পাকিস্তানের শাসকদের তা নিয়ে লোভে লালা ঝরতে পারে, আমি-আপনি কি ক’রে তাদের মধ্যে কোনো একটার পাশে দাঁড়াই? ভারতবর্ষের যে শাসকশ্রেণী প্রতিদিন শোষণ-লুন্ঠন করে চলেছে আপামর ভারতবাসীকে, সেই শাসকশ্রেণীর অজুহাতগুলি কি ক’রে হয়ে উঠতে পারে আমাদের...অর্থাৎ আপামর ভারতবাসীর...যুক্তি?
আসলে আমাদের মনের মধ্যেও একটা ‘রাষ্ট্র’ বেঁচে-বর্তে থাকে; যে ‘রাষ্ট্র’ বাইরের রাষ্ট্র’টার মতোই ধনিকপ্রেমী, পিতৃতান্ত্রিক, দমনমূলক। সুযোগ পেলেই সে অন্যের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়। একদিকে আমরা যৌন-হিংসা থেকে মুক্তি চাই। এমন এক সমাজ চাই যেখানে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ থাকবে না...যেখানে মেয়েরা ‘মেয়ে’ নয়, মানবী। অন্যদিকে মনের মধ্যে গেড়ে-বসে-থাকা ‘রাষ্ট্র’টি কিন্তু ঐ ইচ্ছে’র বিরুদ্ধে কাজ করে। সমাজের ওপর চেপে-বসে-থাকা রাষ্ট্রটি যেমন পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ-প্রভুত্ব-সহায়ক, মনের মধ্যেও ঠিক তাই। হাজার হাজার বছর ধরে এগিয়ে-চলা সমাজে যেমন এই পিতৃতন্ত্রের বিরোধী আদর্শগুলি তৈরি হয়েছে, তেমনি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রূপ বদলে বদলে রয়ে গেছে পিতৃতন্ত্র টিকে থাকার পক্ষের আদর্শগুলিও।
কে না জানে জনবিরোধী ক্ষমতার ভাষা যুগে যুগে একই! তাই পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ যেমন ক্ষমতাকাঠামোকে রসদ দেয়, তেমনই অন্যায়-আধিপত্যের সহায়ক অন্য সব আদর্শই ঐ ক্ষমতাকাঠামোর পুঁজি। তাই সব আধিপত্য ও বৈষম্য-বিরোধী লড়াই কোথাও না কোথাও এক সুতোয় বাঁধা থাকে।
সেই সুতোর টানেই হয়তো যে কাশ্মীরী নারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর লাঠি-গুলি-শিশ্নের উল্টো দিকে ছুঁড়ে দেন থুথু কিম্বা পাথর, সেই একই নারী বোরখার অন্তরালে পর্দানসীন করার ওয়াহাব-সংকীর্ণতা ছিঁড়ে ফেলে মনে করিয়ে দেন সুফী উদারতার ঐতিহাসিক পীঠস্থান কাশ্মীরকে। শুধু সংখ্যা বাড়াতে নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে শান্তির জন্য যুদ্ধের সামনের সারিতে যখন ক্রমশ হাজারে হাজারে পৃথিবীজুড়ে পথে নামছেন মেয়েরা, তখন রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যের ‘পুরুষ’-মুখের বিপরীতে প্রতিস্পর্ধী ‘নারী’বোধের নিরন্তর নির্মাণ ঘটিয়ে-চলা প্রতিবাদী কাশ্মীরী মেয়েরা যে ঐ একই সারির যোদ্ধা, তা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না আমাদের।
এই মুক্তিকামী লড়াকু কাশ্মীর থেকেই কলকাতায় আসছেন নাতাশা রাঠের ও ইফ্রা বাট। ২৫ বছর আগের সেই কলঙ্কময় সেনা অভিযানকে স্মরণ ক’রে প্রকাশিত হয়েছে ৫ জন অসমসাহসিনী প্রতিবাদী নারীর লেখা বই “ডু ইউ রিমেম্বার কুনান পোশপোরা”। নাতাশা ও ইফ্রা ঐ ৫ জন সংগ্রামী লেখিকার মধ্যে অন্যতম ২ জন।
আগামী ১২ই জুলাই (মঙ্গলবার), বিকেল ৪-টেয় মধ্য-কলকাতার ভারত সভা হল-এ আমাদের আয়োজিত আলোচনাসভায় মূলত নাতাশা আর ইফ্রা’র থেকেই আমরা শুনবো গত ২৫ বছর জুড়ে কাশ্মীরী মেয়েদের লড়াইয়ের কথা, লাঞ্ছনা-ধর্ষণ-মৃত্যুর অগণিত মিছিল পেরিয়েও নিরন্তর বহমান মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিভাষ্য।
কথোপকথনে থাকবেন জয়া মিত্র, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অগ্নিগর্ভ সত্তর দশকের অগ্নিকন্যারা, বলবেন ছত্তিশগড়ে গত চার দশক জুড়ে চলা শ্রমিক আন্দোলন-প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম-সহ ভারত জোড়া মানবাধিকার আন্দোলনের পরিচিত মুখ ঈলিনা সেন, বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে মদের ভাঁটি-ভাঙ্গার লড়াইয়ের মুখ সামিমা খাতুন, হায়দ্রাবাদের প্রান্তিকায়িত যৌনতাভুক্ত দলিত মানুষদের সংগ্রামের প্রতিনিধি রচনা, অসংগঠিত শ্রমিকদের লড়াইয়ের মর্মবস্তু-অনুসন্ধানকারী গবেষিকা আলবিনা, আফস্পা-বিরোধী গণ-আন্দোলনের অন্যতম মুখ নিশা বিশ্বাস। নিজেদের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে মুক্তিকামী কাশ্মীরকে খুঁজে দেখবেন ওঁরা।
প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-প্রতিস্পর্ধার এই ভাষা ও ভাষ্যগুলি অভিন্ন নয়। আবার ভিন্নও নয়। বক্তাদের দেখা আর আমার-আপনার এতদিন-পর্যন্ত উপলব্ধি মিলতে পারে, নাও মিলতে পারে। ঐ দিন আমি-আপনিও তাই বলবো, প্রশ্ন করবো। সংলাপ-বৈচিত্র্যে সভা হোক অন্তর্ঘাতী। যৌন-হিংসার বিরুদ্ধে লিঙ্গ-সাম্যের জন্য নানা প্রান্তের লড়াইগুলো তবেই না স্বপ্নে স্বপ্নে মিলে যাবে স্বাধীনতার পূর্ণ আকাশে...
অর্ধেক আকাশ
বন্দনা মন্ডল (৭৬০২৪৮৯৪৮০) ও ঈশিতা কুন্ডু (৮০১৩৭০৭৭৬২) কর্তৃক প্রকাশিত এবং জয়তি পাল (৯৮৭৪৪০২০১৪) ও রূপকথা বসু (৯০৩৮২০২৭১৭) কর্তৃক প্রচারিত।।
ফেসবুক নিঙ্কঃ
https://www.facebook.com/ardhek.akash.9 ;
https://www.facebook.com/ardhek.akash.9 ;
ই-মেলঃ ardhekakash2006@gmail.com
No comments:
Post a Comment