কেন হিন্দু প্রশ্ন?
Farhad Mazhar
বদরুদ্দিন উমর সম্প্রতি বেশ কয়েকটি লেখায় বাংলাদেশে হিন্দু প্রশ্ন ও সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ তুলেছেন। দুটো প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক..কাকে আমরা সাম্প্রদায়িকতা বলব? কিভাবে সেটা নির্ধারিত হবে? দুই. যদি আমরা সংখ্যালঘু নিয়ে কথা বলতে চাই তাহলে ‘প্রকৃত সংখ্যালঘু’ কারা? প্রকৃত সংখ্যালঘু নির্ণয়ের পদ্ধতিও বা কিভাবে ঠিক হবে?
এই প্রকার প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অনুমান হচ্ছে একটি জাতিবাদী রাষ্ট্রে বাঙালি হিন্দু কিভাবে সংখ্যালঘু হয়? সেতো বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের ভিত্তিতে জাতিবাদী ক্ষমতা তৈরির কর্তা, জাতিতান্ত্রিক ক্ষমতার শরিক এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কন্সস্টিটিউন্সি। প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত রাখার বিপজ্জনক দিক হচ্ছে ‘সংখ্যালঘু’ ধারণার ভুল প্রয়োগ করতে গিয়ে আমরা প্রকৃত সংখ্যালঘুদের আড়াল করছি। আমরা ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্ব ভুলে যাচ্ছি। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দুর প্রশ্নকে সংখ্যাগুরু/সংখ্যালঘুর বিতর্কে পর্যবসিত করবার অতি সরলীকরণ বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতি সত্তার প্রশ্নকে গৌণ, এমনকি অদৃশ্য করে দিচ্ছে। সেকারনে বাংলাদেশে ‘হিন্দু’ প্রশ্নকে আলাদা ভাবে পর্যালোচনা করতে হবে, কারনে বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা।
ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রাবল্য এবং ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় হিন্দুত্ববাদী শক্তির অধিষ্ঠানের কারনে বাংলাদেশের ‘হিন্দু’ প্রশ্ন নতুন ভাবে সামনে চলে এসেছে। বিশেষত পাশাপাশি যখন বাংলাদেশের হিন্দুরা নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক নন, বরং স্পষ্ট ভাবেই হিন্দু হয়ে থাকবার দাবি তুলছেন। ইতোমধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের প্রতিনিধি হিসাবে রানা দাশগুপ্ত ১৬ অগাস্ট ২০১৫ তারিখে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশে হিন্দুদের জন্য আলাদা আসন দাবি করেছেন। বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট আরও স্পষ্ট ভাবে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা, পৃথক মন্ত্রণালয় ও সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসনের দাবি জানিয়েছে। অস্বীকার করবার উপায় নাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু প্রশ্ন নতুন রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। বদরুদ্দিন উমরের লেখা এবং সেই লেখা নিয়ে বিতর্ক সে কারণে খুবই সময়োচিত হয়েছে।
মার্কস-লেনিনের ধ্রুপদি চিন্তার জায়গায় দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিচারকে শ্রেণি রাজনীতির অধীনে বিবেচনার তাগিদ থেকে বাংলাদেশের হিন্দু প্রশ্ন মীমাংসার ক্ষেত্রে উমর আমাদের চিন্তার অভিমুখ পদ্ধতিগত ভাবে বদলাবার প্রস্তাব করছেন। যেন জাতিবাদী ও ফ্যসিস্ট বয়ান থেকে বেরিয়ে আমরা আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সমাজে দ্বন্দ্বসংঘাতের চরিত্রকে সঠিক ভাবে বুঝতে পারি। কেবল তখনই সমস্যার সমাধানের জন্য সঠিক নীতি ও কৌশল অবলম্বন সম্ভব । উমরের তত্ত্বগত অনুমান কিম্বা সাম্প্রদায়িকতার সামাজিক ভিত্তি বাংলাদেশে আছে কি নাই তা নিয়ে তর্ক হতেই পারে। কিন্তু আমাদের চিন্তার অভিমুখ বদল ও হিন্দুর নির্যাতন মাত্রই সাম্প্রদায়িকতা প্রমাণ করবার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসার প্রস্তাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি তাঁর লেখা নিয়ে তর্ক আন্তরিক ও ইতিবাচক দিকেই আমাদের নেবে।
তার লেখা পড়ে হীনমন্যতায় ভোগা বামদের মতো আমাদের ভিমরি খাবার দরকার নাই। এদের ধারণা হিন্দুর ওপর নির্যাতনকে সাম্প্রদায়িক না বললে বুঝি সেই নির্যাতন অস্বীকার করা হয় কিম্বা তাকে রুখে দেবার আশূ প্রয়োজনীয়তা ও ন্যায্যতা কমে যায়। একাজ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেবার দেবার ক্ষেত্রে ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপির হাতকেই এই বামেরা শক্তিশালী করছে। তারা বদরুদ্দিন উমরকে অন্যায় ভাবে সমালোচনা করছে যা তাদের হীনমন্যতার অভিব্যাক্তি মাত্র। সত্যকারের সমস্যার কোন সমাধান নয়।
No comments:
Post a Comment