Joyraj Bhattacharjee
কোন কারণে কাল থেকে বেশ কিছু মানুষ নারীবাদ এবং পুরুষতন্ত্র সম্পর্কে আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাইছেন। এতজন মানুষ একসাথে একই বিষয়ে আমার মত একজন হরিজনের কাছে কিছু জানতে চাইছে, এটা একটা কাকতাল। কিন্তু সেই কাকতাল আমায় বেশ আমোদ দিচ্ছে।প্রথমত আমি বিষয় দুটি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। এবং এই না জানার জন্য আমার কোন শ্লাঘা নেই গ্লানি আছে। আমার বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে অনেকেই এ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানচর্চা করেন, তাঁদের প্রতিও আমার প্রবল শ্রদ্ধা ও সম্ব্রম। আমি এই দুটি বিষয়ে তাঁদের কাছ থেকেই সামান্য জেনেছি কখনও।
আমার বড় হওয়া হাওড়ার একটি অতি নিম্নবিত্ত পরিবারে, বাবা মা দুজনেই কলেজে যান নি। বাবা এমনকি স্কুলের পড়াশোনাও শেষ করেন নি, তার আগেই কাজে ঢুকে পড়তে হয়েছে, কুলির কাজ। আমার পড়াশোনা ১২ ক্লাস পর্যন্ত। বাড়িতে বাবা জ্যাঠারা কম্যুনিস্ট পার্টী করতেন, বিভাজনের আগে থেকেই। জ্যেঠুকে জেল খাটতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। বাবা খেলাধুলোয় বেশ কৃতি ছিলেন। লং ডিস্টেন্স দৌড়তেন, জেলায় বেশ নাম ছিল। পদক ছিল অনেক, মায়ের কাছে শুনেছি, দেখিনি। আমার জন্মের আগে সে সব বিক্রি হয়ে গেছে। এই কথাগুলো যদি কোন ভাবে আমার প্রতি কোন সহানুভুতি তৈরি করে, তাহলে ভুল হবে, সেটা এই কথাগুলো লেখার উদ্দেশ্য নয়। আর সহানুভুতির খুব জায়গাও নেই, কারণ এই চূড়ান্ত দারিদ্রর সম্মুখিন আমি হইনি। কিন্তু এটুকু জানানোর দরকার বলে মনে হল, এইটা বোঝাতে যে আমার ছোটবেলায় দুটো জিনিস আমাকে আকর্ষণ করছে- সিরিয়াস খেলাধুলো আর সিরিয়াস রাজনীতির চর্চা। কিন্তু সেটাই বা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক কেন? প্রাসঙ্গিক এই কারণে- এটা দুর্ভাগ্যের আমি হাওড়া জেলার বাম রাজনীতিতে পুরুষতন্ত্র বা নারীবাদকে নিয়ে কোন চর্চা প্রতক্ষ্য করিনি কখনও। বরং পরে বুঝেছি যে রাজনীতির চর্চা চলত তা যথেষ্ট পুরুষতান্ত্রিক এবং নারীবিদ্বেষী। এবং সেই রাজনীতিতেই আমরা অংশ নিয়েছি, সমর্থন দিয়েছি, আর সমর্থন দিতে দিতে বড় হয়েছি। অর্থাৎ আমরা বড় হয়েছি নারীবিদ্বেষী বা অন্তত পক্ষে আমি বড় হয়েছি নারীবিদ্বেষী মনোভাব লালন করতে করতেই। আর খেলাধুলোর ক্ষেত্রে বিশেষত যে খেলাটা আমি সিরিয়াসলি খেলেছি অনেকদিন- ফুটবল, সেখানে কেউ খারাপ খেললে তাকে বলতাম- মেয়েছেলের মত খেলিস না ল্যাওড়া। অথবা হাফলাইনের আগেই মাগীদের মত ফাইনাল ট্যাকল করছিস? এটুকু না বললেই নয়, একজন প্রমিসিং স্টপারের নিজেকে যথেষ্ট রাফ এন্ড টাফ প্রতিপন্ন করার জন্য।
আমার বড় হয়ে ওঠা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এই বিদ্বেষ আঁকড়ে। এমনকি এটা যে বিদ্বেষ সেটাও খুব চিনতে পারছি এমন নয়। কেউ রিকশাচালক কে নির্দ্বিধায় তুই বললে কিন্তু সমস্যাটা বুঝতে পারছি, এমনকি তাকে শাসনও করছি- কেন ওঁকে তুই বলছিস বে খানকির বাচ্চা? নানা বিষয়ে মাতব্বরি করছি তখন। কিন্তু নারীবাদের সামান্যতম ধারনাও কোথাও নেই। প্রথম এই একমুখীন বয়ানে কিছুটা ঝঞ্ঝাট বাঁধায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তারও পরে ব্রেখট। কিন্তু সেটাও বলার মত কিছু না।দারুণ সচেতন হয়ে উঠি এমন নয়।
যদি কোথাও সামান্য কোন সচেতনতা তৈরি হয়ে থাকে আদৌ, তা হয়েছে আমার নারীবাদী বন্দুদের সাথে ঝগড়া মারামারি করতে করতে। যেমন এই মুহূর্তে Aritry Das এর কাছ থেকে আমি কত জিনিষই না জানছি। কত জিনিষকে দেখার ভঙ্গী বদলে জাছছে।তাই বলে কি আমি নারীবাদ নিয়ে জ্ঞান দেওয়ার অধিকারী? না, আমি নই। প্রথমেই বলেছি এ বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমিত বললেও বাড়িয়ে বলা হবে, এ বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই। এবং সেটা লজ্জার। সেই লজ্জার মাথা খেয়ে আমি অরিত্রির কাছ থেকে শিখি বয়সের তোয়াক্কা না করে। আমি নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নারীবিদ্বেষ এবং পুরুষ তান্ত্রিক মানসিকতাকে অল্প অল্প করে চিনছি। ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছি এবং বুঝতে পারছি ঝেড়ে ফেলা অত সহজ নয়। এ কাজটা সাড়া জীবন ধরেই করে যেতে হবে।
কিন্তু ততদিন কি হবে? যতদিন না আমি একজন পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠছি, এই সমস্ত গণ্ডগোল শোধন করে? ততদিন কি আমি অরিত্রির ওপর হওয়া নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুখ খুলবো না? আলবাত খুলবো। যেমন মাও বলেছেন লড়তে লড়তেই লড়াই শিখতে হবে। সম্পূর্ণ শিখে নিয়ে লড়তে নামার অবকাশ নেই। কিন্তু এতো গেল, একরকম- কিন্তু যদি আমার বিরুদ্ধেই এই সময়কালের মধ্যে নিপীড়নের অভিযোগ উঠে আসে? আমি বলবো আমার বন্ধুদের এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠো। আমার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠো। অনেক লড়াই করে যে অধিকার অর্জন করা গেছে তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করো। কোন আহারে বেচারি করোনা। কোন খাপ পঞ্চায়েতও করোনা। তা প্রাথমিক ভাবে সহায়তা করতে পারে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সম্ভবত করবে না। কারণ খাপ পঞ্চায়েত আমি যা বুঝেছি আদতে পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষতন্ত্র আর নারীবাদ নিয়ে আমার এটুকুই এই মুহূর্তে বলার। আর বলার নারীবাদের স্বপক্ষে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমার বলার কথাগুলো আমি বলবই কারোর আপ্রুভালের অপেক্ষা না করে। কারণ আপ্রুভালের রাজনীতির মিথ্যাচার আমি নারীবাদ ও পুরুষতন্ত্রের রাজনীতির চেয়ে অন্তত বেশি জানি। দাবী করছি প্রায় সবটাই জানি।
No comments:
Post a Comment