Wednesday, June 22, 2016

Yashodhara Ray Chaudhuri আমার ভেতরে প্রবাহিত হয় একটা অদ্ভুত মাতৃতন্ত্র।

আমার ভেতরে প্রবাহিত হয় একটা অদ্ভুত মাতৃতন্ত্র। এই মাতৃতন্ত্রের হদিশ অনেকেরই কাছে আছে। যারা আমার বান্ধবী। তবু, লিখে রাখার ইচ্ছে অনুভব করি , আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতটাকে উপেক্ষা করতে পারিনা বলেই।
যখন ছোট ছিলাম, দিদিমা , মা, মায়ের পিশিমা, এমনকি মাসি , যিনি বিদেশে থাকতেন , সকলকেই দেখতাম একটা সেলাইকলে সেলাই করতে। অতিপ্রাচীন উষা সেলাইকল, পাদানি সম্পন্ন, পা দিয়ে চাপ দিয়ে চালানো চলে, আবার হাতল ঘুরিয়ে হাত মেশিনের মতও চালানো যায়। আমার দিদার মেশিন। সেই মেশিন হয়ত বা দিদার বিয়ের সময়ে তিনি পেয়েছিলেন, যৌতুক হিসেবে, ঢাকা থেকে। হয়ত বা কলকাতায় কিনেছিলেন। ১৯২০ সালের আশপাশের কোন সময়ের জিনিশ সেটি।
দিদার বাড়িতে এই সেলাইকল থাকত।
মায়ের আর একটি সেলাইকল ছিল, সেটা সিংগার মেশিন। আমাদের অনতিশৈশবে, ১৯৭৮ এর বন্যার কথা মনে আছে স্পষ্ট। টানা দু চারদিন বাড়ি থেকে বেরোন নেই, বৃষ্টির বিরাম নেই, এমনকি রাস্তাঘাটের তখনকার অবস্থা যা, তাতে জল নেমে যাওয়ার আশাও নেই। সেই অবস্থায় চাল ডাল আলু আর পেঁয়াজ সমবল, এবেলা খিচুড়ি ওবেলা খিচুড়ি খাওয়া হচ্ছিল, তখনও ম্যাগি ওঠেনি বাজারে মনে হয়, উঠে থাকলে, এক প্যাকেট ম্যাগির সঙ্গে এক প্যাকেট সাধারণ চাউ মেশানো হত, মশলার অপটিমাল ব্যবহারের জন্য। রেডিও চলছে, সংবাদ পরিক্রমা আর সংবাদ বিচিত্রায় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনিন্দ্য কন্ঠস্বরে শুনে চলেছি গ্রামবাংলার দুর্দশার কথা।
আর, সারাদিন ঘরঘর ঘরঘর , সেলাই করে চলেছেন আমার মা। কী সেলাই করছেন ? শাড়ির ছিঁড়ে রাখা চওড়া পাড়গুলো। যা জুড়ে জুড়ে অসংখ্য কাঁথা তৈরি করছেন। আমরা সেলাইকলের চারপাশ জুড়ে গল্পবই বা মুড়ির বাটি নিয়ে বসে আছি। মা রঙ মেলাচ্ছেন, আর টানা সেলাই দিয়ে দিয়ে জুড়ে যাচ্ছেন পাড়।
আর কিছু করার নেই। মন খারাপ হয়ে যাবে বৃষ্টিতে আটকে যাওয়া জীবনের কথা ভাবলেই। তাই, মা ওভাবেই এড়িয়ে চলেছেন ডিপ্রেশনের ভেতরদিকটা।
এইসব স্মৃতি জুড়ে জুড়েই আমার মেয়েবেলা ক্রমশ সেলাইকলে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। আমারও মন খারাপ হলে সেলাই করতে ইচ্ছে করে। মন ভাল হলেও। কলেজে যখন পড়ি, তখন জামা বানাতাম, ব্লাউজ বানাতাম। চেষ্টা করতাম সালোয়ার কামিজ বানানোর। কাটিং নিয়ে বই খুঁজতাম, বন্ধুদের সঙ্গে অনেক সময়েই শেয়ারও করতাম। কনীনিকার দিদি কমলিকাদিও খুব সেলাই করত, ওর সঙ্গে এই নিয়ে গল্প চলত। কমলিকাদি দারুণ বানাত সালোয়ার কামিজ।
আমি চাকরি পাই ১৯৮৯ সালে। বি সি এস। চাকরির টাকা দিয়ে প্রথমেই কিনে ফেললাম সিঙ্গারের ফ্যাশন মেকার। যা দিয়ে নাকি ২৫ রকমের ডিজাইন করা যায়। কিন্তু মেশিনটা প্রচন্ড সমস্যা দিতে শুরু করল। আমারও ব্যস্ততা বাড়ছিল, তাছাড়া সৃষ্টি করার সুখ সেভাবে পাচ্ছিলাম না সেলাই ফোঁড়াইয়ে। যদিও বহুদিন বলে যেতাম সবাইকে, আমি ফ্যাশন ডিজাইনার হতে চাই।
এর পর চাকরি বদল, কলকাতা ত্যাগ, ফিরে আসা , বিবাহ, সুতলির জন্ম। সবের মধ্যে অফ অ্যান্ড অন, আমার সিঙ্গার ফ্যাশন মেকার আর মায়ের সেলাইকলটা ব্যবহার করেছি। সুতলির কাঁথা থেকে শুরু করে, সুতলির জন্য পোশাকও বানিয়েছি অনেক। তার কয়েকটা এখনো এদিক ওদিক আলমারির ভেতর আছে।
তারপর সময় কমে গেল। লেখালেখি বেড়ে গেল। লেখার ভেতর সৃষ্টির আনন্দ হয়ত বেশি পাচ্ছিলাম, তাই সেলাই নিয়ে আমার কোন উচ্চাশা আর রইল না।
ইতিমধ্যে ২০০১ এ চলে গেলেন দিদা। আমার মা মাতৃসূত্রে ইনহেরিট করলেন, দিদার সেই উষা মেশিন।
ভবানীপুরের বাড়িতে গত ১৩ বছর ধরে ঐ মেশিন পড়ে আছে। মা সেলাই করেননি। আমিও করিনি। ২০০৮ এ মায়ের দেহান্তের পরও, আমাদের এই বাড়িতে তিন তিনটে সেলাই কল রয়ে গেছে, তিন প্রজন্মের।
আজ, ও এল এক্স পর বেচ দো বিজ্ঞাপন দেখে উৎসাহিত আমি, মায়ের সিঙ্গার সেলাই কলটা পাড়ার ইস্তিরিওয়ালার মেয়ে, যে সেলাই কাটিং শিখেছে, তাকে দিয়ে দিলাম। আর, দিদারটা, দান করা বা বেচার প্রশ্নই ওঠে না। ওটা তো অ্যান্টিক! তাই ওটা বার করে, আজ তেল টেল দিয়ে পুঁছে চকচকে করলাম।
জানতাম চাকা ঘুরবে না আর।
কিন্তু ঘুরল। ১৩ বছর পড়ে থাকা সেলাই কল, ফুটোতে মেশিন অয়েল ঢালতেই , নড়ে চড়ে উঠল... তারপর খানিকক্ষণের মধ্যেই প্রতিটি পার্ট খুলে তেল দিলাম। ফোঁটা ফোঁটা।
তারপর , ঘন্টাখানেকের মধ্যে, সেলাই করলাম কলটা দিয়ে। সত্যি সত্যি! পর্দা সেলাই করলাম, ছিঁড়ে যাওয়া বা সেলাই খুলে যাওয়া একটা কি দুটো পোশাকেও “টানা দিলাম”, মায়েদের ভাষায়।
একটা ব্লাউজ অল্টার করলাম...
আর, সমস্ত দেহে মনে এক অদ্ভুত আরাম ছেয়ে গেল। মনে হচ্ছিল দিদার আদর খাচ্ছি, মায়ের কাছে বসে আছি। আশ্চর্য আমি, এত বছর পড়ে থেকেও যে মেশিন এত সহজে চালু হয়, তা কত ভাল মানের! কত ভাল তার ভেতরের খোল নলচে, যন্ত্রপাতি! ছোট্ট, সুন্দর, অসম্ভব ক্রিয়াশীল, ঠিক এক ঘরোয়া, দ্রুত কাজ করে ফেলা, তৎপর চটপটে গিন্নিমার মত যন্ত্রটা আজ আমার দিনটাকে একেবারে ঝলমলে করে দিল...
ঘর্ঘর আওয়াজে গোটা দিনটা সঙ্গীতময় হয়ে গেল।

No comments:

Post a Comment