রবীন্দ্রনাথের “নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ” গোতমা বুদ্ধের ‘আত্তদীপ ভব” উপলব্ধির গভীরতম অনুরণনঃ
Saradindu Uddipan
আত্ত মগ্নতায় নিজের অস্তিত্বের খোঁজে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক অনন্য পরিব্রাজক ভাবুক কবি। অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের মার্গে বিচরণ এবং আত্ম উপলব্ধির সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠায় উত্তীর্ণ হয়ে নিব্বানা লাভের মাধ্যমে সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত জীবন এবং বিশ্বমানবতার বিজয় কেতন ওড়ানোই ছিল তার অভিলাষ। মহামতি গোতমা বুদ্ধের “আত্তদীপ ভব” এই গভীর সনাতন বাণী তার জীবন প্রকোষ্ঠের কন্দরে কন্দরে ছড়িয়ে দিয়েছিল এক শুচি শুভ্র চেতনার আলো। বুদ্ধের দয়া, প্রেম, করুণা এবং আত্তমগ্নতা তার জীবনকে এমন ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল তার প্রকাশ পাই “নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ” কবিতায়। কবিতাটি তার ২২ বছর বয়সের একটি অনন্য রচনা যা “কড়ি ও কোমল” কাব্যে প্রকাশিত হয়েছিল।
কবিতাটির একেবারে শুরু থেকেই সূচীত হয়েছে এক ঘুম ভাঙ্গানীয়া চেতনার বাণী। হৃদয়ের গভীর গহন তলদেশ থেকে উঠে এসেছে ঢেউ জাগানিয়া এক অকৃত্রিম আবেশ। একটি স্নিগ্ধ আলোর উষ্ণতা এবং তার উদাত্ত আহ্বান কি ভাবে দীর্ঘকালীন জড়ত্বকে ভেঙ্গে চুরমার করে আত্তপ্রকাশের উন্মুক্ত আলোয় উদ্ভাসিত করতে পারে তা এই কবিতার সুর ঝংকারে অনুরণিত হয়েছে বার বার।
কবিতাটির মূল ভাব এবং অন্তর্নিহিত বার্তা পরিকল্পিত হয়েছে একটি জলবিন্দুর আত্তকথনের মাধ্যমে। এক অনন্তের অংশীদার সে। সীমাহীন জলরাশি তার একান্ত আলয়। কালের সুগভীর পরিকল্পনা মেনেই তাকে বিবর্তিত হতে হয়। বিভাজিত হতে হয় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কনিকায়। জাগতিক নানা বৈষম্য, নানা প্রতিকূলতায় সে হিমশৈলের আকারে বন্দী হয়ে পড়ে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কন্দরে কন্দরে। শৈত্য আরো প্রকট হলে সে একেবারে গতিহীন হয়ে পড়ে। সুপ্তি তাকে গ্রাস করে। সে ভুলে যায় তার আত্মপরিচয়, ঘরে ফেরার তাগিদ।
একদিন অন্ধকারের আগল ভেঙ্গে প্রখর সূর্য কিরণ তাকে উতপ্ত করে। ভেঙ্গে ফেলে শৈত্যের বাঁধন। গুহার ভিতর থেকে শুনতে পায় পাখির কূজন। জীবন ঝংকৃত হয়ে ওঠে প্রানের আনন্দে। এক মহামিলনের নেশায় উছলে ওঠে তার প্রানের আবেগ।
একদিন অন্ধকারের আগল ভেঙ্গে প্রখর সূর্য কিরণ তাকে উতপ্ত করে। ভেঙ্গে ফেলে শৈত্যের বাঁধন। গুহার ভিতর থেকে শুনতে পায় পাখির কূজন। জীবন ঝংকৃত হয়ে ওঠে প্রানের আনন্দে। এক মহামিলনের নেশায় উছলে ওঠে তার প্রানের আবেগ।
এ আবেগ কোন বাঁধা মানে না। ছুটে চলতে চায় পাহাড় থেকে পাহাড়ে, লুটতে চায় ভূধর থেকে ভূধরে। আত্তউপলব্ধির এই মহাসন্ধিক্ষণে এসে সে বুঝতে পারে তার জীবন ভাষ্যে আছে অনন্ত কথামালা, অনন্ত প্রানের গান। এ যেন জড়ত্ব থেকে মুক্তির এক প্রবল বিদ্রোহ। সত্য, করুণার নির্মল বারিধারায় ধৌত করে এ শুধু বিশ্বপ্রেমের দুর্বার জয়গান গাওয়া। উথাল পাথাল মন, উদ্বেলিত বারিধারা নিয়ে সে শুনতে পায় মহাসাগরের গান। মহাসাগর জীবনবোধের এক মহাসংগম। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেতনার সমন্বয়ে পরম সত্যের সন্ধান। জীবন বোধের এই উজ্জীবিত বোধিসত্ত্বার কাছে সমস্ত কারাগারের কঠিন বাঁধনই তুচ্ছ, ভঙ্গুর ও অর্থহীন।
এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহতের মেল বন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন। বুকের মাঝে বিশ্বলোকের আহ্বান করেছেন। আসলে অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ফলে যে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছিল, যে নবজাগরণের ঢেউ লেগে ভেঙ্গে পড়েছিল সুপ্রাচীন কালের ধ্যান ধারনা, ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল জীর্ণ পুরাতন ব্যাধি। জীব কল্যাণ হয়ে উঠেছিল সভ্যতার অভিমুখ। সেই কল্যাণকামী সামাজিক পরিবর্তনের দুর্দম অভিঘাতকে শৈল্পিক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ কবিতায়।
তৎকালীন ভারতীয় সমাজের সাম-দাম-দন্ড-ভেদ নীতির কারণে যে ভাবে মানবিক মূল্যবোধ ধুলায় লুণ্ঠিত হচ্ছিল তার স্বরূপটিকেও উদ্ঘাটন করেছেন কবি। সামাজিক ভেদনীতির ফলে খণ্ডিত হচ্ছিল মানবাতা। মানুষে মানুষে ছিল বিভেদের প্রাচীর। মুক্তচিন্তা, স্বাধীন চেতনা আটকা পড়ে যাচ্ছিল দুর্লঙ্ঘ নীতির নিগড়ে। ক্লেদাক্ত পঙ্কিলে ঢাকা পড়েছিল চারধার। তেমনি এক প্রদোষকালে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার মত ভারতবর্ষের মনন ক্ষেত্রেও আছড়ে পড়েছিল রেনেসাঁ। ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ডাক শোনা যাচ্ছিল বাতাসে বাতাসে। জ্ঞানের স্নিগ্ধ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল উপলব্ধির আনাচে কানাচে। মুক্তির এই মরমী বাণী রবীন্দ্রনাথ অগ্রাহ্য করতে পারেননি। তাই সত্য, প্রেম, করুণার বেগবান ফল্গুধারা নিয়ে তিনি মিলিত হতে চাইছিলেন বিশ্বপ্রেমের মহাসংগমে।
No comments:
Post a Comment