Tuesday, May 31, 2016

আর কত রক্ত ? ।। শিবানী দে।

আর কত রক্ত ?


 ।। শিবানী দে।।
     
          
(C)Image:ছবি
সেদিন আবারও দিল্লির রাজপথে আফ্রিকীয় নিধন ।  আফ্রিকা একটা বিশাল মহাদেশ,নাইজিরিয়াকেনিয়াকঙ্গোমরক্কো কত দেশ থেকে মানুষ এদেশে আসেসেসব পরিচয় আমাদের এখানে গুরুত্ব পায় না । তার মধ্যে কত ছাত্রকত খেলোয়াড়, কত সরকারিকত ব্যবসায়ীবা শুধুই ভ্রমণকারীতারও কিছু জানবার দরকার নেই। তার মধ্যে কেউ বা হয়তো কোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে থাকতেই পারেযেমন শ্বেতাঙ্গ আগন্তুকদের মধ্যেও থাকে । কিন্তু  শুধু আফ্রিকীয়রা কালো,দেখতে অন্যরকম, (যারা কালো নয়, তাদের কথা আলাদা) সেটাই একমাত্র বিবেচ্য হয়ে থাকেআর যেহেতু তারা তুলনামূলকভাবে গরিব দেশের লোকতাই তাদের কেউ অপরাধ করলে সেই স্টিকার ওদের সার্বজনীন কপালে সাঁটা হয়ে যায় ।
          কেন অন্যরকম দেখতে লোকজন এদেশে মানুষের মর্যাদা পায় না যে কোনো অজুহাতে তাদের উপর অত্যাচারবলাৎকারহত্যা করতে হাত কাঁপে নাবিবেকে বাধে না নাকি বিবেক এখন ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অন্যরকম চেহারা হলেই মানুষ নিজের স্বজাতিকে এক সাধারণ প্রাণী বলেই ভাবছেখুশি খুশি মেরে ফেলা যায় । মানুষ কেন এত অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে সমাজ কি ঠগখুনিতে ভরে যাচ্ছে 
          মাঝখানে কিছুদিন খবরে কাগজে বা টিভিতে এই ধরণের খবর ছিল না । তবে তখন ছিল ভোটের বাজার----অন্য কিছু ঘটে থাকলেও তেমন প্রকাশ্যে আসে নি । এবার একজন আফ্রিকান নিহত,পাথরের ঘায়ে । অন্যজন তার বন্ধুআহত । এরা এখানে এসেছিল পড়াশুনো করতে । শিক্ষিতআরো কিছু শেখার আশায় এসেছে । সামান্য অটো ধরা নিয়ে বচসাহাতাহাতি । ভূমিপুত্রদের নিজেদের স্বার্থে অটো জবরদখল । প্রতিবাদী লোকটি বিদেশিকালোদেখতে অন্যরকমতার সংখ্যার জোর নেই । অতএব তার বাঁচবার অধিকারও নেই ।
       একইভাবে কয়েক মাস আগে বেঙালুরুর রাস্তায় এক আফ্রিকান মহিলাকে নগ্ন করে ঘোরানো হয়েছিল । হায়দরাবাদেও একজন আফ্রিকান খুন হয়েছিল । প্রত্যেকটা শহরে একই চিত্র । অভদ্র অশ্লীল অসহিষ্ণু হিংস্র ভূমিপুত্র । আমাদের জায়গাআমাদের রাজত্ব । আমরা যা ইচ্ছে করতে পারি । অজুহাত দেবতোমরা ড্রাগ পাচারকারীচোর, নেশাখোর-----যা খুশি । প্রমাণের দায়িত্ব আমাদের নেইআমাদের খুশিই আইন ।
       সরকার আবার বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দেয়, ‘অতিথিদেবো ভব। এসব বুলি অনেক হাজার বছর পুরোনোতামাদি হয়ে গেছে ।
       তবে আফ্রিকীয় অতিথিদের সান্ত্বনা হতে পারে যে আমাদের এইসব ভূমিপুত্ররা নিজেদের দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গেও একই ব্যবহার করে । দিল্লি বেঙালুরুতে ওরাও পড়াশুনোর জন্যকাজের জন্য আসে । ওদেরও দেখতে অন্যরকমচালচলন একটু আলাদা, অতএব ওরাও খিল্লিবঞ্চনাশারীরিক পীড়ন,ধর্ষণএমনকি হত্যারও যোগ্য । অজুহাতসে কিছু একটা দিলেই হল । ওরা ড্রাগখোরড্রাগ পাচার করে,ওদের মেয়েরা ছেলেদের মধ্যে বেশ খোলামেলাস্বাধীনভাবে মেলামেশা করে । যেহেতু ওদের মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে ঘোরে, অতএব ওরা একশ শতাংশ ধর্ষণের যোগ্য ।’ ওদেরও বেশি সংগঠন নেইকাজেই প্রতিবাদের তেমন জোর নেই ।
     ভূমিপুত্রদের ভাবখানা এরকমযে আমরাই এখানকার মালিকআমরা যাকে খুশি ল্যাজায় কাটতে পারি,মুড়োয় ও কাটতে পারি । আমাদের গায়ে হাত দেবে ওদের সামর্থ্য নেই । পুলিশ কি করবে পুলিশ তো আমাদেরই লোক ।’ তাই এতসব করেও এইসব খুনে ঠগরা পার পেয়ে যায় ।
     পশ্চিমী দেশগুলোতে বৈষম্য মোটামুটি একমাত্রিক বা দ্বিমাত্রিকসেখানে ধনী-গরিব, সাদা- কালো/বাদামির মধ্যে বর্ণবৈষম্য । আমাদের দেশে বৈষম্য বহুমাত্রিক । এখানে ধনী-দরিদ্রসাদা-কালো,  ককেশীয়-মঙ্গোলীয়, উচ্চবর্ণ-দলিতহিন্দু-মুসলমাননারী-পুরুষ, (রাজনৈতিক দলগুলোর আর নাম করলাম না) বৈষম্যের মাত্রার সংখ্যা নেই । কে কাকে কখন আক্রমণ করবেকার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার কোনো হদিশ নেই । কারণের দরকারও বড় একটা হয় নাছুতো থাকলেই যথেষ্ট । জোর যার বেশিতারই অন্যের উপর কর্তৃত্বের অধিকার । সেই কর্তৃত্ব কখনো লুটদখলদারিকখনো বলাৎকার কখনো হত্যাকখনো বা সবকিছু একসঙ্গে । আক্রমণ আজকাল আর পারস্পরিক নয়, সামূহিকযূথবদ্ধ । আক্রমণকারীরা যেন ক্ষুধার্ত হায়নার পাল । একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মাঝেমাঝে মনে হয় গোটা দেশটাই জঙ্গলে পরিণত হতে যাচ্ছে । শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের স্বর চাপা পড়ে যাচ্ছে। চারদিকে শুধুই হুংকার আর আক্রমণের নেশা, ‘দেখে নেবোবুঝে নেবোর হুমকি ।
    প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও একই ধরণের খবর আসতে থাকে ।
    আমরা কি ফিরে যাচ্ছি হব্‌স্‌(Hobbes) কথিত প্রকৃতির রাজ্যে যেখানে প্রতিটি মানুষ প্রতিযোগী,জান্তবহিংস্রসমাজহীনএকা মনে হয় কোনো শিক্ষাশিল্পসাহিত্যসুকুমারকলা, সঙ্গীত এই অবস্থা থেকে মানুষের উত্তরণ ঘটাতে পারবে না । হয় নৈরাজ্যনয় প্রশাসন ও পুলিস ----এই-ই শেষ কথা ।  ভয়,সন্ত্রাস ও মৃত্যুর ছায়ায় বেঁচে থাকাটাই বোধ হয় আজ মানুষের নিয়তি ।
ঈশানের পুঞ্জমেঘ

No comments:

Post a Comment