আর কত রক্ত ?
।। শিবানী দে।।
(C)Image:ছবি |
সেদিন আবারও দিল্লির রাজপথে আফ্রিকীয় নিধন । আফ্রিকা একটা বিশাল মহাদেশ,নাইজিরিয়া, কেনিয়া, কঙ্গো, মরক্কো কত দেশ থেকে মানুষ এদেশে আসে, সেসব পরিচয় আমাদের এখানে গুরুত্ব পায় না । তার মধ্যে কত ছাত্র, কত খেলোয়াড়, কত সরকারি, কত ব্যবসায়ী, বা শুধুই ভ্রমণকারী, তারও কিছু জানবার দরকার নেই। তার মধ্যে কেউ বা হয়তো কোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে থাকতেই পারে, যেমন শ্বেতাঙ্গ আগন্তুকদের মধ্যেও থাকে । কিন্তু শুধু আফ্রিকীয়রা কালো,দেখতে অন্যরকম, (যারা কালো নয়, তাদের কথা আলাদা) সেটাই একমাত্র বিবেচ্য হয়ে থাকে, আর যেহেতু তারা তুলনামূলকভাবে গরিব দেশের লোক, তাই তাদের কেউ অপরাধ করলে সেই স্টিকার ওদের সার্বজনীন কপালে সাঁটা হয়ে যায় ।
কেন অন্যরকম দেখতে লোকজন এদেশে মানুষের মর্যাদা পায় না ? যে কোনো অজুহাতে তাদের উপর অত্যাচার, বলাৎকার, হত্যা করতে হাত কাঁপে না, বিবেকে বাধে না ? নাকি বিবেক এখন ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ? অন্যরকম চেহারা হলেই মানুষ নিজের স্বজাতিকে এক সাধারণ প্রাণী বলেই ভাবছে, খুশি খুশি মেরে ফেলা যায় । মানুষ কেন এত অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে ? সমাজ কি ঠগ, খুনিতে ভরে যাচ্ছে ?
মাঝখানে কিছুদিন খবরে কাগজে বা টিভিতে এই ধরণের খবর ছিল না । তবে তখন ছিল ভোটের বাজার----অন্য কিছু ঘটে থাকলেও তেমন প্রকাশ্যে আসে নি । এবার একজন আফ্রিকান নিহত,পাথরের ঘায়ে । অন্যজন তার বন্ধু, আহত । এরা এখানে এসেছিল পড়াশুনো করতে । শিক্ষিত, আরো কিছু শেখার আশায় এসেছে । সামান্য অটো ধরা নিয়ে বচসা, হাতাহাতি । ভূমিপুত্রদের নিজেদের স্বার্থে অটো জবরদখল । প্রতিবাদী লোকটি বিদেশি, কালো, দেখতে অন্যরকম, তার সংখ্যার জোর নেই । অতএব তার বাঁচবার অধিকারও নেই ।
একইভাবে কয়েক মাস আগে বেঙালুরুর রাস্তায় এক আফ্রিকান মহিলাকে নগ্ন করে ঘোরানো হয়েছিল । হায়দরাবাদেও একজন আফ্রিকান খুন হয়েছিল । প্রত্যেকটা শহরে একই চিত্র । অভদ্র অশ্লীল অসহিষ্ণু হিংস্র ভূমিপুত্র । আমাদের জায়গা, আমাদের রাজত্ব । আমরা যা ইচ্ছে করতে পারি । অজুহাত দেব, তোমরা ড্রাগ পাচারকারী, চোর, নেশাখোর-----যা খুশি । প্রমাণের দায়িত্ব আমাদের নেই, আমাদের খুশিই আইন ।
সরকার আবার বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দেয়, ‘অতিথিদেবো ভব’। এসব বুলি অনেক হাজার বছর পুরোনো, তামাদি হয়ে গেছে ।
তবে আফ্রিকীয় অতিথিদের সান্ত্বনা হতে পারে যে আমাদের এইসব ভূমিপুত্ররা নিজেদের দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গেও একই ব্যবহার করে । দিল্লি বেঙালুরুতে ওরাও পড়াশুনোর জন্য, কাজের জন্য আসে । ওদেরও দেখতে অন্যরকম, চালচলন একটু আলাদা, অতএব ওরাও খিল্লি, বঞ্চনা, শারীরিক পীড়ন,ধর্ষণ, এমনকি হত্যারও যোগ্য । অজুহাত? সে কিছু একটা দিলেই হল । ‘ওরা ড্রাগখোর, ড্রাগ পাচার করে,ওদের মেয়েরা ছেলেদের মধ্যে বেশ খোলামেলা, স্বাধীনভাবে মেলামেশা করে । যেহেতু ওদের মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে ঘোরে, অতএব ওরা একশ শতাংশ ধর্ষণের যোগ্য ।’ ওদেরও বেশি সংগঠন নেই, কাজেই প্রতিবাদের তেমন জোর নেই ।
ভূমিপুত্রদের ভাবখানা এরকম, যে ‘আমরাই এখানকার মালিক, আমরা যাকে খুশি ল্যাজায় কাটতে পারি,মুড়োয় ও কাটতে পারি । আমাদের গায়ে হাত দেবে ওদের সামর্থ্য নেই । পুলিশ কি করবে ? পুলিশ তো আমাদেরই লোক ।’ তাই এতসব করেও এইসব খুনে ঠগরা পার পেয়ে যায় ।
পশ্চিমী দেশগুলোতে বৈষম্য মোটামুটি একমাত্রিক বা দ্বিমাত্রিক, সেখানে ধনী-গরিব, সাদা- কালো/বাদামির মধ্যে বর্ণবৈষম্য । আমাদের দেশে বৈষম্য বহুমাত্রিক । এখানে ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, ককেশীয়-মঙ্গোলীয়, উচ্চবর্ণ-দলিত, হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষ, (রাজনৈতিক দলগুলোর আর নাম করলাম না) বৈষম্যের মাত্রার সংখ্যা নেই । কে কাকে কখন আক্রমণ করবে, কার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার কোনো হদিশ নেই । কারণের দরকারও বড় একটা হয় না, ছুতো থাকলেই যথেষ্ট । জোর যার বেশি, তারই অন্যের উপর কর্তৃত্বের অধিকার । সেই কর্তৃত্ব কখনো লুট, দখলদারি, কখনো বলাৎকার , কখনো হত্যা, কখনো বা সবকিছু একসঙ্গে । আক্রমণ আজকাল আর পারস্পরিক নয়, সামূহিক, যূথবদ্ধ । আক্রমণকারীরা যেন ক্ষুধার্ত হায়নার পাল । একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মাঝেমাঝে মনে হয় গোটা দেশটাই জঙ্গলে পরিণত হতে যাচ্ছে । শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের স্বর চাপা পড়ে যাচ্ছে। চারদিকে শুধুই হুংকার আর আক্রমণের নেশা, ‘দেখে নেবো, বুঝে নেবো’র হুমকি ।
প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও একই ধরণের খবর আসতে থাকে ।
আমরা কি ফিরে যাচ্ছি হব্স্(Hobbes) কথিত প্রকৃতির রাজ্যে যেখানে প্রতিটি মানুষ প্রতিযোগী,জান্তব, হিংস্র, সমাজহীন, একা ? মনে হয় কোনো শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সুকুমারকলা, সঙ্গীত এই অবস্থা থেকে মানুষের উত্তরণ ঘটাতে পারবে না । হয় নৈরাজ্য, নয় প্রশাসন ও পুলিস ----এই-ই শেষ কথা । ভয়,সন্ত্রাস ও মৃত্যুর ছায়ায় বেঁচে থাকাটাই বোধ হয় আজ মানুষের নিয়তি ।
No comments:
Post a Comment