প্রাসঙ্গিক ভাবনা ॥ ড. মোঃ নূরুল আমিন
জামায়াত-আতঙ্ক ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা
যেখানে যত ঘটনা-দুর্ঘটনাই ঘটুক কেষ্টাকে আবিষ্কার করার অপচেষ্টা পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমের কিছু কিছু কর্মীর বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়। ন্যায়-অন্যায় ও ভালমন্দ জ্ঞান এবং শিষ্টাচার এদের মগজে নেই বললেই চলে। এদের সাথে গত কয়েক বছরে আইন-শৃক্সক্ষলা রক্ষা বাহিনী ও সরকারি দলের এক শ্রেণির কর্মী যুক্ত হয়েছেন যারা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধ এবং ঈমান ও আকিদা-বিশ্বাস সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকেই নিজেদের মুখ্য লক্ষ্যে পরিণত করেছেন বলে ধারণা করা যায়। লক্ষ্য বলুন আর উপলক্ষ বলুন, জামায়াত-শিবিরই হচ্ছে এদের প্রধান টার্গেট। সুদীর্ঘ সাত দশক ধরে প্রকাশ্য ও বৈধ পন্থায় সমাজের প্রতিটি স্তরে সক্রিয় এই দলটি ও তার ছাত্র-ছাত্রী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দু’চারজন এখন একত্রে বসে কোথাও কুরআন-হাদিস ও রাজনীতিচর্চা অথবা আলোচনাসভা কিংবা শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশগ্রহণ করতে পারে না। কিছু কিছু পত্র-পত্রিকা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে জামায়াত-শিবির বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। সরকার, সরকারের আইন-শৃক্সক্ষলা বাহিনীর সদস্য কিংবা তাদের দলীয় ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা এর মধ্যে নাশকতার ষড়যন্ত্রের আভাস পান এবং এই অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করে তাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালান। মৃত ব্যক্তির মাগফিরাতের জন্য আয়োজিত দোয়ার মাহফিল, ইফতার মাহফিল ও কুরআন শিক্ষার আসর থেকে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী, পর্দানশীন মহিলা ও ছাত্রীদের ধরে নিয়ে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ইতিহাস অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, একজন ফেরাউনের আমলে বনি ইসরাইলদের পরিবারে পুত্র সন্তানের জন্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এই ভয়ে যে, ঐ সন্তান ফেরাউনের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের বিদ্যমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে, জামায়াত-শিবির-ইসলামী ছাত্রী সংস্থার বৈধ ও সৎ কার্যাবলি ক্ষমতাসীনদের যেভাবে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে, তাতে হয়তো বেশি দিন দূরে নয়, সরকার বাংলাদেশের জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা অথবা সারা দেশে ছেলে হোক মেয়ে হোক, সন্তান জন্ম নিষিদ্ধ করে দিতে পারে, এই আশঙ্কায়, কে জানে নবজাতক জামায়াত-শিবিরে না যোগ দেয়!
কিছুটা অতীতে ফিরে যেতে চাই। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে কিছু স্মরণীয় ঘটনা থাকে। কিছু ঘটনা থাকে যা তার জীবনের মোড় পর্যন্ত পরিবর্তন করে দিতে পারে। আমার সাংবাদিক জীবনে এমনি ধরনের কিছু ঘটনা আছে যা বিস্মৃত হবার মত নয়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি যখন সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে অবজার্ভার গ্রুপে যোগদান করি তখন সাংবাদিকতার একটি অনাকর্ষণীয় বিষয়ের উপর আমাকে কাজ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এবং এটি ছিল অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা। বলাবাহুল্য, ঐ সময়ে সাংবাদিকতার এই দিকটির উপর হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিকই শুধু কাজ করতেন। এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন জনাব এইচ কে জাভেদ, মুজিবল, রিয়াজউদ্দিন, এরশাদ মজুমদার প্রমুখ। দায়িত্বপ্রাপ্তির কয়েক মাস পর তিতাস গ্যাস কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার জনাব হাবিবুর রহমান সাহেবের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার জন্য একদিন তার মতিঝিল অফিসে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ প্রায় দেড় ঘণ্টা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার পর চা পর্বে এসে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি ম্যাট্রিক পাস করেছি কিনা। ঘটনাটি ঘটেছিল আমার ঢাকা বিশ্ববিদালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়ার দু’বছর পর। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত বরাবরই আমি ভাল ছাত্রদের কাতারে ছিলাম এবং মাস্টার্সে মেধা অনুযায়ী আমি ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিলাম। তদুপরি দীর্ঘ প্রায় দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত জনাব হাবিবুর রহমানের যে সাক্ষাৎকারটি আমি নিয়েছিলাম তাও ছিল ইংরেজিতে। কিন্তু তার পরও তিনি যখন আমার ম্যাট্রিক পাসের খবর জানতে চাইলেন তখন আমার মন-মেজাজের অবস্থা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তথাপিও অত্যন্ত শান্তভাবে তাকে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা অবহিত করে তার মনে কেন এ প্রশ্নের উদ্রেক হলো জিজ্ঞাসা করতেই রহমান সাহেব বিনয়ের সাথে মাফ চেয়ে বললেন যে তার এবং তার মত অনেকেরই ধারণা ছিল পত্র-পত্রিকায় যারা কাজ করেন তারা লেখাপড়া জানেন না, তাদের কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও একটি সাধারণ বিশ্বাসের কথা বললেন যে, সাংবাদিক এবং বীমা কোম্পানির দালাল এই দুটি শ্রেণির লোককে শিক্ষিত ও ভদ্র শ্রেণীর লোকেরা ডাহা মিথ্যাবাদী বলে মনে করেন। তারা যা বলেন ও লিখেন তার সাথে বাস্তব সত্যের কোনও মিল নেই।
তারা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেন। তার ঐ দিনের কথাটি একজন নবীন সাংবাদিক হিসেবে আমাকে খুবই আহত করেছিল। অবশ্য তার বিশ্বাসের যৌক্তিকতা আমি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে উপলব্ধি করেছি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল এই ঘটনার কিছু দিন পর। ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন। তারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য পত্র-পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থা পরিদর্শন শেষে ম্যানিলা ফিরে যাবার পর বিমানবন্দরে কিছুসংখ্যক সাংবাদিক তাদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘How did you find press in Pakistan?’ প্রতিনিধি দলের নেতা এর উক্তর দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘We found very little press in Pakistan. What we found most was prestitution. Prostitution-এর সুন্দর অপভ্রংশ prestitution. Prostitute-রা পয়সার বিনিময়ে ঘৃণ্য দেহ ব্যবসা করে। আর আইপিআই প্রতিনিধি দলের ধারণা অনুযায়ী পয়সা ও বিত্তের বিনিময়ে এতদাঞ্চলের সাংবাদিকদের বৃহত্তর অংশই বিবেক ও কলমের ব্যবসা করে। এ জন্য তারা সত্যকে গোপন করে মিথ্যার বেসাতি করে বেড়ান। যে কোন সাংবাদিকের জন্য এ ধরনের উপমা অপমানকর এবং দুর্ভাগ্যজনক সন্দেহ নেই। তথাপিও কর্মজীবনে এসে এর অনেক সাক্ষাৎ প্রমাণ আমি পেয়েছি।
তৃতীয় ঘটনাটি ১৯৭০ সালের ১৮ জানুয়ারি তারিখের। জামায়াতের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। এতে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর বক্তৃতা করার কথা ছিল। অবজারভার ভবনে আমরা এর আগের দিন খবর পেলাম যে, জামায়াতকে পল্টন ময়দানে এই সভা করতে দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, পিকিং ও মস্কোপন্থী বলে পরিচিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির উভয় গ্রুপ ঐক্যবদ্ধভাবে জামায়াতের সভা প- করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পূর্ব দেশ সম্পাদক মরহুম মাহবুবুল হক, অবজারভার সম্পাদক মরহুম আবদুস সালাম এবং অবজারভার গ্রুপের মালিক জনাব হামিদুল হক চৌধুরী পূর্ব দেশ সম্পাদকের কক্ষে আমি এবং অবজারভারের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক নাসিম ভাইকে ডেকে পাঠালেন। তারা আমাদের বললেন যে, ১৮ তারিখের জামায়াতের জনসভার কাভারেজ দিয়ে ঐ দিন সন্ধ্যায় যেন আমরা তাদের কাছে একটি বিশেষ রিপোর্ট পেশ করি। কোনও জনসভার কাভারেজ দেয়া আমাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পূর্ব দেশের রিপোর্টিং-এ তখন জনাব ফয়েজ আহমদ, সলিমউল্লাহ, রফিকুল হক, মঈন উদ্দিন, রকীব সিদ্দিকী, হোসেন তওফিক সিদ্দিকী প্রমুখ এবং অবজারভারের আতাউস সামাদ, আবদুর রহিম, আবদুল মান্নান প্রমুখ ছিলেন। নিউজ এডিটর ছিলেন যথাক্রমে এহতেশাম হায়দার চৌধুরী ও এবিএম মুসা।
জামায়াত সম্পর্কে তৎকালীন সময়ে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতা কর্মীদের বড় অভিযোগ ছিল, জামায়াত পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। তবে এই দলগুলোর জামায়াত বিরোধিতার মূল কারণ তারা কখনও প্রকাশ্যে বলেনি। একটি আদর্শবাদী দল হিসেবে আমাদের কাছে জামায়াতের পরিচিতি ছিল। যাই হোক, জামায়াতের জনসভার রিপোর্টিয়ের নতুন দায়িত্ব পালনের জন্য আমরা উভয়ে সেদিন বেলা তিনটার সময় পল্টন ময়দানে হাজির হয়েছিলাম। তখন ঢাকা সিটি জামায়াতের আমীর ছিলেন খ্যাতনামা প্রকৌশলী খুররম জাহ মুরাদ। তার সাথে আমার বিশেষ পরিচয় ছিল। গঙ্গা, কপোতাক্ষ বাঁধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ফারাক্কার উপর কয়েকটি রিপোর্টং-এর ব্যাপারে তার দেয়া তথ্য আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। তিনি ছিলেন Associated Consulting Engineers-এর Chief Executive Engineer. সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাকে দেখলাম কর্মীদের দিয়ে পল্টন ময়দানের বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইটের টুকরা ও মাটির ঢেলা সংগ্রহ করে ডায়াসের নিচে রাখছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, সভায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছু লোক গোলমাল করতে পারে বলে তারা খবর পেয়েছেন এবং কেউ যাতে এই কাজে ঢিল ও ইট ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। সেদিন যথারীতি সভা শুরু হয়েছিল। পল্টন ময়দানের ইট ও মাটির ঢেলা সেদিন কেউ ব্যবহার করতে পারেনি।
সেদিন নিরীহ জামায়াত কর্মীরা যখন বিভিন্ন স্থানে সভার শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত, পল্টন ময়দান অর্ধেক ভরে গেছে। সাধারণ মানুষ আরো আসছে। মওলানা মওদূদী সাহেব তখনো সভাস্থলে পৌঁছেননি। বেলা তখন চারটা। দেখা গেল স্টেডিয়ামের ছাদ থেকে সভাস্থলের উপর ইস্টক বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রোতারা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করছেন। এমন সময় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের লাঠিধারী অসংখ্য কর্মী স্রোতাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দাড়ি-টুপি নির্বিশেষে যাকেই তারা সামনে পেয়েছে তার ওপরই লাঠি চালিয়েছে। সাংবাদিক গ্যালারিতে আমাদের পাশেই ছিলেন সাপ্তাহিক ইয়ং পাকিস্তান সম্পাদক জনাব আজিজ আহমেদ বিলিয়ামিনী। সত্তুর এর উপরে বয়স। লাল টুকটুকে চেহারা, সারাটা মাথায়ই টাক। এক সময় দৈনিক স্টার অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ছিলেন।
জনাব বিলিয়ামিনী সাহেব ছিলেন উপমহাদেশের হাতেগোনা নগণ্য সংখ্যক প্রতিভাবান সাংবাদিকদের একজন, সাংবাদিকতা বিষয়ে যার উচ্চতর ডিগ্রী ছিল। লাঠির আঘাত থেকে তার বৃদ্ধ মাথাও রেহাই পায়নি। ফিনকি দিয়ে তার মাথা থেকে যখন রক্ত বেরুচ্ছিল তখন তাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম। যাই হোক, সেদিনের এই ঘটনা ও নিরীহ মানুষের আর্তনাদ এখনো আমার কানে বাজে। সেদিন নাসিম ভাইসহ আমরা অবজারভার ও পূর্বদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে এই ঘটনার একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন পেশ করেছিলাম। কিন্তু ঐদিন রাতেই ফয়েজ ভাইসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী সাংবাদিকদের নেতৃত্বে প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত পত্রিকাগুলোর রিপোর্টারদের একটি সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, পল্টন ময়দানে জামায়াতের সভার বস্তুনিষ্ঠ কোন সংবাদ প্রকাশিত হবে না। তার পরিবর্তে প্রেস ক্লাব থেকে প্রদত্ত গাইড লাইন অনুযায়ী তৈরিকৃত একটি ইউনিফর্ম রিপোর্ট ছাপা হবে। এই গাইড লাইনটির মূল কথা ছিল জামায়াতের গু-ারা পল্টন ময়দানে নিরীহ শ্রোতাদের উপর হামলা করেছে। পরদিন সকাল বেলা সকল পত্রিকায় এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছিল। খবরের এই শিরোনামকে অর্থবহ করার উদ্দেশ্যে ঘটনাকে টুইস্ট করার জন্য যতটুকু মিথ্যার আশ্রয় নেয়া প্রয়োজন ছিল তারা তার সবটুকুই নিয়েছিলেন। সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য করার এই ঘটনা সেদিন আমার নবীন সাংবাদিক মনে একটি বিরাট আঁচড় টেনেছিল এবং হাবিবুর রহমান সাহেবের কথাটিকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলো।
সত্যি কথা বলতে গেলে সেদিনের এই ঘটনায় জামায়াতবিরোধী প্রত্যক্ষদর্শী বহু সাংবাদিককে জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলতে সাহায্য করেছিলো।
এত বছর পর এই ঘটনাগুলো মনে পড়ার একটা কারণ হয়তো পাঠক- পাঠিকারা আমার কাছে জানতে চাইবেন। বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশে বেশকিছু রাজনৈতিক দল এবং নেতা-নেত্রী সাংঘাতিকভাবে জলাতঙ্ক রোগের ন্যায় জামায়াতঙ্ক রোগে ভুগছেন। জামায়াতকে হাটে-মাঠে-ঘাটে সর্বত্র নাজেহাল ও হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে এমনভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে মনেই হয় না যে, জামায়াত ছাড়া দেশে অন্য কোন সমস্যা আছে।
কয়েক বছর আগে সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরের সঙ্গে আলাপ করছিলাম। ভদ্রলোক একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন হবার পর সরাসরি আর্মিতে যোগ দেন এবং এরশাদ আমলের মাঝামাঝি সময়ে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসর প্রদান করা হয়। তিনি একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। তার সাথে আলোচনার একপর্যায়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও অবস্থা, অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রাপ্তি এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের তথাকথিত বিরোধিতার কারণে জামায়াতের প্রতি আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলগুলোসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দলের বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণু মনোভাবের বিষয়ও এসে পড়ে। কথা প্রসঙ্গে মেজর সাহেব ১৯৭০ সালের ১৮ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের দ্বারা জামায়াতের জনসভায় হামলার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন এবং অকপটে স্বীকার করেন যে, উক্ত সভায় যেই ছাত্র লাঠিয়াল বাহিনী হামলা করেছিল তিনি তাদেরই একজন ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তখনো স্বাধীনতা বিরোধিতার প্রশ্ন ছিল না তথাপিও কেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ সেক্যুলার ও সমাজতন্ত্রী দলগুলো জামায়াতের সভায় হামলা করত। বরিশালের বাসিন্দা মেজর সাহেব তার উত্তরে আঞ্চলিক একটি টান দিয়ে হেসে বললেন জামায়াত তখন পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল তখন ছিলো পাকিস্তানের রক্ষক। তিনি আরও একটি অট্টহাসি দিয়ে বিষয়টি আরও খোলাসা করলেন। বললেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ অনন্তকাল ধরে অব্যাহত থাকবে। কেননা তারা যে আদর্শের রাজনীতি করে সেই ইসলাম যদি কায়েম হয় তাহলে অনেকেই হাতকাটা, সঙ্গেছার হওয়া ও বালাখানা হারানোর ভয়ে ভীত। তিনি প্রশ্ন করলেন আপনি যদি অবৈধ বিত্ত, লাগামহীন ক্ষমতা, প্রতারণা, উচ্ছৃঙ্খল নারী ও ব্যভিচারের মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে থেকে দুনিয়াতেই বেহেশতের আস্বাদ লাভে ব্যাপৃত থাকেন তাহলে জাামায়াতের কথায় পরকালের আশায় বর্তমানের এই সুখ-বিসর্জন দিতে কি রাজি হবেন? এককালের সন্ত্রাসী-ছাত্রনেতা এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যা বুঝলাম তাতে মনে হলো যে, বহু পূর্বেই তিনি তারপূর্ব অবস্থান থেকে সরে গেছেন। বর্তমানে তিনি যুক্তির কষ্টি পাথরে বিচার বিবেচনা করার চেষ্টা করেন। তার প্রশ্নের মধ্যে বর্তমান জামায়াত বিরোধিতার মূল কারণ খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না।
এই কারণগুলোই ইসলাম-বিরোধী শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করছে এবং তাদের নীল-নকশা অনুযায়ী জামায়াত নির্মূলের অংশ হিসেবে ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলায় ভাড়াটিয়া সাক্ষী দাঁড় করিয়ে তাদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাচ্ছে। ক্ষমতালিপ্সু অত্যাচারী স্বৈর শাসকদের এতে উল্লসিত হবার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। মরহুম মাওলানা মওদূদী বলতেন, স্বৈরশাসক ও জালেমরা তাদের পতনের সকল পথ রুদ্ধ করতে সক্ষম হলেও আজরাইল আগমনের একটি ছিদ্র বন্ধ করতে পারে না। এই ছিদ্র পথেই আজরাইল আসেন এবং তাদের পতন ঘটে। আবার আল্লাহ্র ইচ্ছার ফেরাউনের ঘরেই মূসার (আ.) লালন-পালন ও শক্তিবৃদ্ধি ঘটে এবং তিনিই ফেরাউনের পতন ঘটান। দু’ভাগ্য হচ্ছে জালেম ও স্বৈরশাসকরা এই সত্যগুলো ভুলে যান। অবশ্য ঈমানদারদের জন্য সর্বদা এগুলো অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। এই বিষয়গুলোর বাস্তবতা উপলব্ধি করে অপপ্রচারে লিপ্ত সাংবাদিক সমাজ বস্তুনিষ্ট সাংবাদিকতায় ব্রতী হবেন বলে আমার বিশ্বাস।
কিছুটা অতীতে ফিরে যেতে চাই। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে কিছু স্মরণীয় ঘটনা থাকে। কিছু ঘটনা থাকে যা তার জীবনের মোড় পর্যন্ত পরিবর্তন করে দিতে পারে। আমার সাংবাদিক জীবনে এমনি ধরনের কিছু ঘটনা আছে যা বিস্মৃত হবার মত নয়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি যখন সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে অবজার্ভার গ্রুপে যোগদান করি তখন সাংবাদিকতার একটি অনাকর্ষণীয় বিষয়ের উপর আমাকে কাজ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এবং এটি ছিল অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা। বলাবাহুল্য, ঐ সময়ে সাংবাদিকতার এই দিকটির উপর হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিকই শুধু কাজ করতেন। এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন জনাব এইচ কে জাভেদ, মুজিবল, রিয়াজউদ্দিন, এরশাদ মজুমদার প্রমুখ। দায়িত্বপ্রাপ্তির কয়েক মাস পর তিতাস গ্যাস কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার জনাব হাবিবুর রহমান সাহেবের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার জন্য একদিন তার মতিঝিল অফিসে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ প্রায় দেড় ঘণ্টা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার পর চা পর্বে এসে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি ম্যাট্রিক পাস করেছি কিনা। ঘটনাটি ঘটেছিল আমার ঢাকা বিশ্ববিদালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়ার দু’বছর পর। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত বরাবরই আমি ভাল ছাত্রদের কাতারে ছিলাম এবং মাস্টার্সে মেধা অনুযায়ী আমি ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিলাম। তদুপরি দীর্ঘ প্রায় দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত জনাব হাবিবুর রহমানের যে সাক্ষাৎকারটি আমি নিয়েছিলাম তাও ছিল ইংরেজিতে। কিন্তু তার পরও তিনি যখন আমার ম্যাট্রিক পাসের খবর জানতে চাইলেন তখন আমার মন-মেজাজের অবস্থা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তথাপিও অত্যন্ত শান্তভাবে তাকে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা অবহিত করে তার মনে কেন এ প্রশ্নের উদ্রেক হলো জিজ্ঞাসা করতেই রহমান সাহেব বিনয়ের সাথে মাফ চেয়ে বললেন যে তার এবং তার মত অনেকেরই ধারণা ছিল পত্র-পত্রিকায় যারা কাজ করেন তারা লেখাপড়া জানেন না, তাদের কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও একটি সাধারণ বিশ্বাসের কথা বললেন যে, সাংবাদিক এবং বীমা কোম্পানির দালাল এই দুটি শ্রেণির লোককে শিক্ষিত ও ভদ্র শ্রেণীর লোকেরা ডাহা মিথ্যাবাদী বলে মনে করেন। তারা যা বলেন ও লিখেন তার সাথে বাস্তব সত্যের কোনও মিল নেই।
তারা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেন। তার ঐ দিনের কথাটি একজন নবীন সাংবাদিক হিসেবে আমাকে খুবই আহত করেছিল। অবশ্য তার বিশ্বাসের যৌক্তিকতা আমি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে উপলব্ধি করেছি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল এই ঘটনার কিছু দিন পর। ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন। তারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য পত্র-পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থা পরিদর্শন শেষে ম্যানিলা ফিরে যাবার পর বিমানবন্দরে কিছুসংখ্যক সাংবাদিক তাদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘How did you find press in Pakistan?’ প্রতিনিধি দলের নেতা এর উক্তর দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘We found very little press in Pakistan. What we found most was prestitution. Prostitution-এর সুন্দর অপভ্রংশ prestitution. Prostitute-রা পয়সার বিনিময়ে ঘৃণ্য দেহ ব্যবসা করে। আর আইপিআই প্রতিনিধি দলের ধারণা অনুযায়ী পয়সা ও বিত্তের বিনিময়ে এতদাঞ্চলের সাংবাদিকদের বৃহত্তর অংশই বিবেক ও কলমের ব্যবসা করে। এ জন্য তারা সত্যকে গোপন করে মিথ্যার বেসাতি করে বেড়ান। যে কোন সাংবাদিকের জন্য এ ধরনের উপমা অপমানকর এবং দুর্ভাগ্যজনক সন্দেহ নেই। তথাপিও কর্মজীবনে এসে এর অনেক সাক্ষাৎ প্রমাণ আমি পেয়েছি।
তৃতীয় ঘটনাটি ১৯৭০ সালের ১৮ জানুয়ারি তারিখের। জামায়াতের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। এতে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর বক্তৃতা করার কথা ছিল। অবজারভার ভবনে আমরা এর আগের দিন খবর পেলাম যে, জামায়াতকে পল্টন ময়দানে এই সভা করতে দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, পিকিং ও মস্কোপন্থী বলে পরিচিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির উভয় গ্রুপ ঐক্যবদ্ধভাবে জামায়াতের সভা প- করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পূর্ব দেশ সম্পাদক মরহুম মাহবুবুল হক, অবজারভার সম্পাদক মরহুম আবদুস সালাম এবং অবজারভার গ্রুপের মালিক জনাব হামিদুল হক চৌধুরী পূর্ব দেশ সম্পাদকের কক্ষে আমি এবং অবজারভারের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক নাসিম ভাইকে ডেকে পাঠালেন। তারা আমাদের বললেন যে, ১৮ তারিখের জামায়াতের জনসভার কাভারেজ দিয়ে ঐ দিন সন্ধ্যায় যেন আমরা তাদের কাছে একটি বিশেষ রিপোর্ট পেশ করি। কোনও জনসভার কাভারেজ দেয়া আমাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পূর্ব দেশের রিপোর্টিং-এ তখন জনাব ফয়েজ আহমদ, সলিমউল্লাহ, রফিকুল হক, মঈন উদ্দিন, রকীব সিদ্দিকী, হোসেন তওফিক সিদ্দিকী প্রমুখ এবং অবজারভারের আতাউস সামাদ, আবদুর রহিম, আবদুল মান্নান প্রমুখ ছিলেন। নিউজ এডিটর ছিলেন যথাক্রমে এহতেশাম হায়দার চৌধুরী ও এবিএম মুসা।
জামায়াত সম্পর্কে তৎকালীন সময়ে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতা কর্মীদের বড় অভিযোগ ছিল, জামায়াত পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। তবে এই দলগুলোর জামায়াত বিরোধিতার মূল কারণ তারা কখনও প্রকাশ্যে বলেনি। একটি আদর্শবাদী দল হিসেবে আমাদের কাছে জামায়াতের পরিচিতি ছিল। যাই হোক, জামায়াতের জনসভার রিপোর্টিয়ের নতুন দায়িত্ব পালনের জন্য আমরা উভয়ে সেদিন বেলা তিনটার সময় পল্টন ময়দানে হাজির হয়েছিলাম। তখন ঢাকা সিটি জামায়াতের আমীর ছিলেন খ্যাতনামা প্রকৌশলী খুররম জাহ মুরাদ। তার সাথে আমার বিশেষ পরিচয় ছিল। গঙ্গা, কপোতাক্ষ বাঁধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ফারাক্কার উপর কয়েকটি রিপোর্টং-এর ব্যাপারে তার দেয়া তথ্য আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। তিনি ছিলেন Associated Consulting Engineers-এর Chief Executive Engineer. সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাকে দেখলাম কর্মীদের দিয়ে পল্টন ময়দানের বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইটের টুকরা ও মাটির ঢেলা সংগ্রহ করে ডায়াসের নিচে রাখছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, সভায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছু লোক গোলমাল করতে পারে বলে তারা খবর পেয়েছেন এবং কেউ যাতে এই কাজে ঢিল ও ইট ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। সেদিন যথারীতি সভা শুরু হয়েছিল। পল্টন ময়দানের ইট ও মাটির ঢেলা সেদিন কেউ ব্যবহার করতে পারেনি।
সেদিন নিরীহ জামায়াত কর্মীরা যখন বিভিন্ন স্থানে সভার শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত, পল্টন ময়দান অর্ধেক ভরে গেছে। সাধারণ মানুষ আরো আসছে। মওলানা মওদূদী সাহেব তখনো সভাস্থলে পৌঁছেননি। বেলা তখন চারটা। দেখা গেল স্টেডিয়ামের ছাদ থেকে সভাস্থলের উপর ইস্টক বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রোতারা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করছেন। এমন সময় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের লাঠিধারী অসংখ্য কর্মী স্রোতাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দাড়ি-টুপি নির্বিশেষে যাকেই তারা সামনে পেয়েছে তার ওপরই লাঠি চালিয়েছে। সাংবাদিক গ্যালারিতে আমাদের পাশেই ছিলেন সাপ্তাহিক ইয়ং পাকিস্তান সম্পাদক জনাব আজিজ আহমেদ বিলিয়ামিনী। সত্তুর এর উপরে বয়স। লাল টুকটুকে চেহারা, সারাটা মাথায়ই টাক। এক সময় দৈনিক স্টার অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ছিলেন।
জনাব বিলিয়ামিনী সাহেব ছিলেন উপমহাদেশের হাতেগোনা নগণ্য সংখ্যক প্রতিভাবান সাংবাদিকদের একজন, সাংবাদিকতা বিষয়ে যার উচ্চতর ডিগ্রী ছিল। লাঠির আঘাত থেকে তার বৃদ্ধ মাথাও রেহাই পায়নি। ফিনকি দিয়ে তার মাথা থেকে যখন রক্ত বেরুচ্ছিল তখন তাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম। যাই হোক, সেদিনের এই ঘটনা ও নিরীহ মানুষের আর্তনাদ এখনো আমার কানে বাজে। সেদিন নাসিম ভাইসহ আমরা অবজারভার ও পূর্বদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে এই ঘটনার একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন পেশ করেছিলাম। কিন্তু ঐদিন রাতেই ফয়েজ ভাইসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী সাংবাদিকদের নেতৃত্বে প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত পত্রিকাগুলোর রিপোর্টারদের একটি সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, পল্টন ময়দানে জামায়াতের সভার বস্তুনিষ্ঠ কোন সংবাদ প্রকাশিত হবে না। তার পরিবর্তে প্রেস ক্লাব থেকে প্রদত্ত গাইড লাইন অনুযায়ী তৈরিকৃত একটি ইউনিফর্ম রিপোর্ট ছাপা হবে। এই গাইড লাইনটির মূল কথা ছিল জামায়াতের গু-ারা পল্টন ময়দানে নিরীহ শ্রোতাদের উপর হামলা করেছে। পরদিন সকাল বেলা সকল পত্রিকায় এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছিল। খবরের এই শিরোনামকে অর্থবহ করার উদ্দেশ্যে ঘটনাকে টুইস্ট করার জন্য যতটুকু মিথ্যার আশ্রয় নেয়া প্রয়োজন ছিল তারা তার সবটুকুই নিয়েছিলেন। সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য করার এই ঘটনা সেদিন আমার নবীন সাংবাদিক মনে একটি বিরাট আঁচড় টেনেছিল এবং হাবিবুর রহমান সাহেবের কথাটিকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলো।
সত্যি কথা বলতে গেলে সেদিনের এই ঘটনায় জামায়াতবিরোধী প্রত্যক্ষদর্শী বহু সাংবাদিককে জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলতে সাহায্য করেছিলো।
এত বছর পর এই ঘটনাগুলো মনে পড়ার একটা কারণ হয়তো পাঠক- পাঠিকারা আমার কাছে জানতে চাইবেন। বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশে বেশকিছু রাজনৈতিক দল এবং নেতা-নেত্রী সাংঘাতিকভাবে জলাতঙ্ক রোগের ন্যায় জামায়াতঙ্ক রোগে ভুগছেন। জামায়াতকে হাটে-মাঠে-ঘাটে সর্বত্র নাজেহাল ও হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে এমনভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে মনেই হয় না যে, জামায়াত ছাড়া দেশে অন্য কোন সমস্যা আছে।
কয়েক বছর আগে সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরের সঙ্গে আলাপ করছিলাম। ভদ্রলোক একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন হবার পর সরাসরি আর্মিতে যোগ দেন এবং এরশাদ আমলের মাঝামাঝি সময়ে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসর প্রদান করা হয়। তিনি একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। তার সাথে আলোচনার একপর্যায়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও অবস্থা, অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রাপ্তি এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের তথাকথিত বিরোধিতার কারণে জামায়াতের প্রতি আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলগুলোসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দলের বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণু মনোভাবের বিষয়ও এসে পড়ে। কথা প্রসঙ্গে মেজর সাহেব ১৯৭০ সালের ১৮ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের দ্বারা জামায়াতের জনসভায় হামলার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন এবং অকপটে স্বীকার করেন যে, উক্ত সভায় যেই ছাত্র লাঠিয়াল বাহিনী হামলা করেছিল তিনি তাদেরই একজন ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তখনো স্বাধীনতা বিরোধিতার প্রশ্ন ছিল না তথাপিও কেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ সেক্যুলার ও সমাজতন্ত্রী দলগুলো জামায়াতের সভায় হামলা করত। বরিশালের বাসিন্দা মেজর সাহেব তার উত্তরে আঞ্চলিক একটি টান দিয়ে হেসে বললেন জামায়াত তখন পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল তখন ছিলো পাকিস্তানের রক্ষক। তিনি আরও একটি অট্টহাসি দিয়ে বিষয়টি আরও খোলাসা করলেন। বললেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ অনন্তকাল ধরে অব্যাহত থাকবে। কেননা তারা যে আদর্শের রাজনীতি করে সেই ইসলাম যদি কায়েম হয় তাহলে অনেকেই হাতকাটা, সঙ্গেছার হওয়া ও বালাখানা হারানোর ভয়ে ভীত। তিনি প্রশ্ন করলেন আপনি যদি অবৈধ বিত্ত, লাগামহীন ক্ষমতা, প্রতারণা, উচ্ছৃঙ্খল নারী ও ব্যভিচারের মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে থেকে দুনিয়াতেই বেহেশতের আস্বাদ লাভে ব্যাপৃত থাকেন তাহলে জাামায়াতের কথায় পরকালের আশায় বর্তমানের এই সুখ-বিসর্জন দিতে কি রাজি হবেন? এককালের সন্ত্রাসী-ছাত্রনেতা এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যা বুঝলাম তাতে মনে হলো যে, বহু পূর্বেই তিনি তারপূর্ব অবস্থান থেকে সরে গেছেন। বর্তমানে তিনি যুক্তির কষ্টি পাথরে বিচার বিবেচনা করার চেষ্টা করেন। তার প্রশ্নের মধ্যে বর্তমান জামায়াত বিরোধিতার মূল কারণ খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না।
এই কারণগুলোই ইসলাম-বিরোধী শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করছে এবং তাদের নীল-নকশা অনুযায়ী জামায়াত নির্মূলের অংশ হিসেবে ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলায় ভাড়াটিয়া সাক্ষী দাঁড় করিয়ে তাদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাচ্ছে। ক্ষমতালিপ্সু অত্যাচারী স্বৈর শাসকদের এতে উল্লসিত হবার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। মরহুম মাওলানা মওদূদী বলতেন, স্বৈরশাসক ও জালেমরা তাদের পতনের সকল পথ রুদ্ধ করতে সক্ষম হলেও আজরাইল আগমনের একটি ছিদ্র বন্ধ করতে পারে না। এই ছিদ্র পথেই আজরাইল আসেন এবং তাদের পতন ঘটে। আবার আল্লাহ্র ইচ্ছার ফেরাউনের ঘরেই মূসার (আ.) লালন-পালন ও শক্তিবৃদ্ধি ঘটে এবং তিনিই ফেরাউনের পতন ঘটান। দু’ভাগ্য হচ্ছে জালেম ও স্বৈরশাসকরা এই সত্যগুলো ভুলে যান। অবশ্য ঈমানদারদের জন্য সর্বদা এগুলো অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। এই বিষয়গুলোর বাস্তবতা উপলব্ধি করে অপপ্রচারে লিপ্ত সাংবাদিক সমাজ বস্তুনিষ্ট সাংবাদিকতায় ব্রতী হবেন বলে আমার বিশ্বাস।
No comments:
Post a Comment