Sunday, May 1, 2016

খুঁটিয়ে দেখার নাম যশোধরা রায়চৌধুরী

খুঁটিয়ে দেখার নাম / ছোটগল্প, ২০১৩ এবং গল্পযাপন সম্পর্ক সংখ্যা

খুঁটিয়ে দেখার নাম
যশোধরা রায়চৌধুরী

কাউকে যখন তুমি ভালবাসবে তখন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে। প্রেম মানে আসলে খুঁটিয়ে দেখা। আমি কোনদিন মানুষ ভালবাসতাম না। কারুর দিকে পূর্ণ তাকিয়ে দেখার কষ্টটুকু অব্দি করিনি। পরমেশকে বিয়ে করেছিলাম না ভালবেসেই। তাই পরমেশের দিকে তাকানোর কথা কোনদিন মনে হয়নি। আজ পরমেশের জীবনে ঘেন্না এসেছে, নাকি, আমার এই না তাকানোর ঔদাসিন্যেই। আমি নাকি ওকে অবহেলা করে করে, ওর দিকে না দেখে দেখে, জন্তু বানিয়ে দিয়েছি। পরমেশ এখন অ্যালকোহলিক, পরমেশ এখন পারলে রেপও করবে।
আমি প্রথম মানুষের দিকে তাকানো কাকে বলে, শিখলাম পলটুকে ভালবেসে। পলটু আমার ভাসুরের ছেলে। আমি ওর কাকিমা হই। কিন্তু পয়ঁত্রিশ বছর বয়সে আমি যেদিন ষোল বছরের পল্টুর প্রেমে পড়লাম, আমার কাছে পৃথিবীটা পালটে গেল। আমি নতুন চোখে শুধু পলটুর দিকেই না, পৃথিবীর দিকেই তাকালাম। মানুষ আমাকে টানতে লাগল। মানুষের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকার দরকার পড়ল যেন এই প্রথম। দেখতে পেলাম, কত বিচিত্র বর্ণ গন্ধ মানুষের। কত না বিচিত্র তাদের অভ্যাস, থাকাথাকি।
পলটু জানতেও পারল না, ওর সদ্য কৈশোর পেরোন চঞ্চল তেজাল শরীর, ওর হালকা চালে হাঁটাচলা, ওর গোঁফ গজানো নরম ত্বক, আর হঠাৎ দৃঢ় হয়ে ওঠা চোয়াল, ওর এমনিতে শান্ত কিন্তু রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে ওঠা মেজাজের পৌরুষের রফলা যফলা... সব আমি কী ভাবে ব্লটিং পেপারের কালি তুলে নেওয়ার মত তুলে নিচ্ছলাম। বলা ভাল, শোষণ করে নিচ্ছিলাম।
পলটু জানতেও পারল না, মাত্র ছমাসে অর কাকিমাকে ও কিভাবে পাল্টে দিল। যে কাকিমা সারাজীবন নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায়নি, সারাদিন, সারাদিন যে সময় পেলেই আয়নার সামনে বসে থেকেছে, বিভোর হয়ে শুধু নিজেকে দেখেছে, নিজেকে সাজিয়েছে, নিজের পরিচর্যা করেছে, পাশে কাকুর কাচতে দেওয়া শার্ট , কাকুর ছিঁড়ে যাওয়া ঝোলাব্যাগ , প্যান্ট, কাকুর হারিয়ে যাওয়া পার্স বা ডায়েরি, কত না অবহেলায় পড়ে থেকেছে, সেগুলোকে তুলে নিয়ে কাজের মেয়েকে কাচতে দিতে, বা সেলাই করে দিতে , বা গুছিয়ে উঠিয়ে রাখতেও ধৈর্য ছল না পলটুর কাকিমার। এতই সে উদাসীন।
আজ সেই কাকিমা, বসে বসে দেখে । সবাইকে দেখে। এমনকি পাশের বাড়ির বারান্দা মুছছে যে পাগলাটে ছেলেটা - টুকরা, তাকেও কত না খুঁটিয়ে দেখে।

টুকরাকে এমনিতে মরোন বলত সাদা মাশিমা। সাদা মাসিমা ট্যাঁশ, ছোটবেলায় সাহেব ইশকুলে পড়া। তাই আ মরণ! - বলা ওঁর মানায় না, নইলে টুকরাকে ওইটে বললেও চলত। কিন্তু উনি মোরোন বলেন।
আমাদের ঠিক পাশের, গলির উল্টোদিকের বাড়ি। মাসিমা একলা থাকেন, আর টুকরার মত একটা জড়দ্গবকে দিয়ে কাজ করাতে করাতে মাঝে মাঝে  হতাশ হয়ে গিয়ে ক্ষেপে উঠে চীৎকার করেন।
চীৎকারে কোন ফল হয়না, উল্টে টুকরা আরো ভুলভাল কাজ করে, আরো ঘাবড়ে যায়, অথবা আক্রোশবশেই সব কাজ গুলিয়ে দেয় যাতে সাদা মাসিমা আরো তেতে ওঠে। মাঝে মাঝে নিজেই ক্ষেপে গিয়ে বলে, টুকরা, চিল্লাবেন না তো, চিল্লাবেন না।
ক্ষেপে গেলে ও জন্তুরও অধম। এমনিতেই অনেকটা জন্তুর মতন লাগে ওকে, আমাদের, আমরা , কাজের মেয়ে সবিতা বা আরতিকে বলি, কী করে ওইরকম গাধাটাকে দিয়ে কাজ করান মাসিমা কে জানে। ও কি একটা মানুষ?
সবিতা হি হি করে হাসে। নিপুণ মেয়েলি কর্মকুশলতায় ঝাঁটা বুলিয়ে নেয় খাটের তলায়, হয়ত খানিক ঝুল আর ধুলো গুঁজে দেয় । অথবা হাতের পোঁছাটা দিয়ে নরম করে মুছে নেয় মেঝে।  কাজ ফাঁকি দিয়ে একটানে পুরো মেঝেতে ন্যাতা বুলিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।
 তো এই টুকরা, একেবারে জন্তুর মত, বিশাল চেহারা আর খুব খিদে সারাক্ষণ, খাই খাই করে খুব, টাকা দাও টাকা দাও করে। সামনেই ওকে দেখি বলে নয়, পাড়ায় সব্বাই জানে। ওর ডাক তো আমাদের বাড়িতেও পড়ে, যখন বেশ কঠিন আর গোলমেলে আর নোংরা কাজ থাকে। পয়সার লোভ বা খাবার লোভ দেখালেই ও সুড়সুড় করে আসবে, জানি তো আমরা।
অথচ টুকরার মাথায় বুদ্ধি নেই বলে  ওর বাড়িতে বলে, তোর দ্বারা কিসসু হবে না রে, কিসসু হবে না...। কোন ব্যবসা, চাকরি, কাজে টুকরা কোনদিন চান্স পাবে না। তাই শুধু গতরে খেটে যে দুপয়সা পায় তাই সই। সারাদিন, বছরের ৩৬৫ দিন  গতর খাটাতে হবে টুকরাকে , না খাটালে টাকা আসবে কোত্থেকে, রোজ তিরিশ টাকা করে না দিলে তো ওর বৌদি ভাত মাপবে না। চাল কিনে দিতে হবে, নয়ত তিরিশ টাকা নগদ। ছেঁড়া কাঁথায় শোয়।
ওর বাড়ির লোকগুলো চামার।

সেই যেদিন থেকে পলটুর স্কুল যাওয়া পালটে কলেজ যাওয়া হল, পলটুর মা, মানে আমার জা ওর খাওয়াদাওয়া নাওয়া ধোওয়া নিয়ে ইস্কুলে যত না হাঁসফাঁসিয়ে মরে যেত তার চেয়েও বেশি করেই এখিন অস্থির হয়ে পড়ল ও কিছু খায় না, কখন বেরোয় তার নেই ঠিক... এইসব ভেবেচিন্তে। সেদিন থেকেই আমি বারান্দায় দাঁড়াই। সকালে পলটু বেরিয়ে যাবার সময়ে আমার দিকে তাকিয়ে একবার ঘাড় নাড়ে, আমি টা টা করি। দিদি বারান্দায় এসে আমাকে মোটা শরীরটা দিয়ে কেমন যেন অন্ধ আক্রোশে একটু ঠেলে দিয়ে দাঁড়ায়, বলে, পলটু এখন বড় হয়ে গেছে। ওওসব টাটা করার ন্যাকামি ওর কেহন পছন্দ নয়, বুঝলে ? শোন পলটু, ফাঁকা বাস দেখে উঠবি কিন্তু, আর শোন বাপি, টিফিনটা দিয়ে দিয়েছি ওটা খেও কিন্তু, শুধু ক্যান্টিনের বাসি পচা খাবার গুলো খেয়ে শরীর খারাপ কোর না।
রোজ মাকে জকিয়ে কুড়ি পঁচিশ পঞ্চাশ নিয়ে বেরোয় পলটু। জানে না কি আর দিদি, ও কতটা কী বাইরের খাবার খাচ্ছে? তবু বলবে। তবু ব্যররথ আশায় মা মা নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করবে।
পলটু দৃষ্টিপথ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেই দিদি বারান্দা থেকে সরে যাবে, আর পারি না বাবা, এই এক ছেলে হয়েছে আমার। বলে হাঁসফাঁস করতে করতে যাবে। পুত্রগরবে গরবিনী আমার সন্তানহীনতার দিকে করুণাভরে তাকাবে, কিন্তু তাতে কি, আমি ত ততক্ষণে ওই যে আমার টা টা করার দিকে আড়চোখে পলটুর একটু তাকিয়ে চলে যাওয়া তাতেই রসে বিভোর হয়ে বারান্দা আঁকড়ে আছি। কৃষ্ণচূড়ার লাল লাল হলদে হলদে ফুলে ভরা গাছটা যেভাবে উপচে পড়ছে , আমার মধ্যেও মানুষের দিকে ছুটে যাওয়ার আনন্দ, ভালবাসা আর আগ্রহ। পিঁপড়ের মত আমার চোখ, আমার মন তখন সামনে যাকেই পাবে তারই গায়ে উঠে পড়তে চাইছে।
তাই সামনে পেলাম টুকরাকেই,  সাদা মাসিমার বারান্দায়। ওর দিকেই মন দিলাম।
সাদা মাসিমা বারান্দায় বেরোল।
কেমন আছেন, ও মাসিমা?
ও পিয়ালি, তুমি? আর কী বলি বলতো? ভাল একটুও নেই। সুগারটা আবার বেড়েছে।
আপনার কিন্তু খাওয়া দাওয়া সময়ে করা উচিত মাসিমা। আমি তো দেখি, আপনি কত বেলা অব্দি খান না, আর ওই টুকরাটার পেছনে লেগে থাকেন।
আর বোল না পিয়ালি, এ যে আমাকে কী জ্বালিয়ে খাচ্ছে। আবার এই বৈশাখে নতুন জামা চাই। একটা করে দেব, তারপর সেটা তো হাওয়া হয়ে যাবে।
কেন? পরে না?বিক্রি করে দেয়?
ওর বাড়ির লোকেরাই বোধ হয় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। ওর তাতে কোন হ্যাত ক্যাত আছে? আবার চাইবে? খালি চাইবে। আমাকে চুষে খাচ্ছে একেবারে।
না দিলেই তো হয়।
আর না দিলে। রোজ টিকটিক করে বলে যাবে। গত পুজোয় নতুন জামা নিল। ফুলহাতা কালো শার্ট দিতে হবে। প্যান্টের কাপড় দিতে হবে। আবার মেকিং চার্জও দিতে হবে। সব নিয়ে ছেড়েছে।
আপনি গিয়ে সব কিনলেন?
দূর, আমি যাই কখনো? মেয়েকে বলে পাঠালাম, ও গরিয়াহাট থেকে কিনে এনে দিল।
শুভাদি? ও, বাবা, এত করতে হল ওই টুকরাটার জন্য, ভাবা যায় না আপনারা কী ভাল।
আর সোমাও তো কতকিছু এনে দেয়, জানো না তো । আগের বার এল, একটা ফুল হাতা লাল জিপ দেওয়া জ্যাকেট এনেছে। তার আগের বার গেঞ্জি।  কত কম্বল দিয়েছে। আমি আমার ব্যবহারের চাদর দিয়েছি। সেগুলো যে কিছুদিন গায়ে দেবার পর পরই কোথায় চলে যায়।
 ওকে বলেন না?
বললে এমন হাঁ করে তাকায়, মনে হয় ওর মনেই নেই বুঝি। সব ঢং। আসলে ওকে ওরা বাড়ির থেকেই বলে পাঠায়।
টুকরা বুঝতে পারে না।

মোরোন তুই, বুঝলি, একটা মোরোন। বলেন মাসিমা। সাদা শাড়ি পরত বলে আমরা ডাকি সাদা মাসিমা।
টুকরা ভাবছে, মরণ! মরণ গাল দিচ্ছে, যেমন গাল দেয় বৌদি, মরণ হয়না কেন রে তোর বলে উদয়াস্ত।
এই অবস্থায় টুকরা ধীরে ধীরে বুড়ো হয়ে গেল, চল্লিশ পেরিয়ে পঞ্চাশে পড়ল। কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা খেত, খাই খাই দেখে মাসিমা সকালে চা দিয়ে মুড়ি বা রুটি দিত, সেই সব দাঁতে লাগে, আধা চিবিয়ে গিলে ফেলতে হয়।
অন্য অন্য বাড়িগুলোতেও এখন টুকরার ডাক পড়ে, কুড়ি টাকা দিয়ে কুড়ি বালতি জল তোলানো, বা পুরনো জিনিশে জমা ঘর পরিষ্কার করিয়ে নেওয়া এইসব কাজ আর কেই বা পারে। সারাদিন উদয়াস্ত কাজ করে করেও টুকরার ক্লান্তি ছিল না। এখন ক্লান্তি হয়, মুখের চামড়া তুবড়ে গেছে । আর, ওর কিছু মনে থাকে না। ওর মাথাটাও ধীরে ধীরে দুরবল হয়ে আসছে, সেটা ওর বোকা বোকা হাবা বুদ্ধির ওপরে আর এক কাঠি মুশকিল হয়ে দাঁড়াল।
সাদা মাসিমাও ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে, আমি বুঝতে পারছি। আমার নিজেরও সময় গড়াচ্ছিল। পলটু কীভাবে বড় হয়ে গেছে। আমার থেকে দূরে গেছে, ওর বাবা মার থেকেও দূরে , অনেক দূরে। বেঙ্গালুরুতে কাজ করে। আমার জা প্রায়ই ওর বিয়ে দেওয়ার কথা তোলে, কিন্তু ওর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না।
আমার জায়ের থেকে আমি একটা ব্যাপারে জিতে আছি। আমাদের ঘরে কম্পিউটার আছে, কম্পিউটারে ইন্টারনেট আছে। পরমেশ এইসব করেছে রাত্তিরে নিজের শেয়ারবাজারের কাজের জন্য, কিন্তু আমাকে বাধা দেওয়ার কথাই ওঠেনা। আমার দিনটা এখন নেটের দৌলতে আর আগের মত একঘেয়ে নেই। রান্না বা কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে নেট খুলে বসি। আর পলটুকে আড়াল থেকে দেখি। পলটুর ছবি, পলটুর কথা, পলটুর গন্ধ।
ওর ফেসবুক বান্ধবী হয়েছে অনেক।  আমি আজকাল ফেসবুক খুলেছি নিজের, নিজের পাতা থেকে যত না আনন্দ আছে, বেশি আনন্দ পাই এর ওর তার পাতায় পাতায় ডালে ডালে ঘুরে। পলটুর কত বন্ধুবান্ধবী। তাদের পাতায় গেলে মনে হয় অনেক মজা আছে এখনো, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গল্প আড্ডা খিস্তি আর এ ওকে খুনসুটি দেখলে , ওদের তরতাজা ছবিগুলো দেখলে এখনও নিজের বয়সটা কম বলে মনে হয়। আমার চল্লিশ পয়ঁতাল্লিশের কষ্ট থাকেনা। কাজ কাজ কাজ , সারাদিন একটা দমদেওয়া পুতুলের মত কাজ করে যাই যে, সে কষ্ট থাকেনা।
আগে পরমেশকে ভালবাসিনি , সে কথা বুঝতে পেরে আমার কষট হয় খুব। ওর প্রেশার হয়েছে, হার্টের জন্য ওকে তেল ঘি মশলা কম খেতে হয়। এখন বুঝি, যৌবনকালে কাউকে না ভালবাসলেও , বুড়োবয়সে তার জন্য অনেককিছু করার মানে। আমার মাকে দেখেছি, আশির পর বাবা যখন পুরো শিশু হয়ে গেল, ডাক্তার বলল, পার্কিনসন ডিজিজ, মাথার স্নায়ুগুলো একে একে মরে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে উনি সব ভুলে যাবেন, তখন সেই অবোধ বাবাকে নিয়ে মা কীরকম থেকেছে।
বাবাকে ছোট বাচ্চার মত নাইয়েছে, খাইয়েছে, হাগিয়েছে, ছুঁচিয়েছে। বাবাও দু আড়াই বছরের বাচ্চার মত আ আ করে মাকে ডাকত। মা ঘুমোলে, মাকে ঘুম থেকে তোলার জন্য খিমচে দিত। মা চেঁচাত। সেবার বাবা পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে চৌচির। হাসপাতালে ভর্তি । ডাক্তার বলল, চলাফেরার অসুবিধে ওনার থাকবেই, নার্ভ শুকোতেই থাকবে,  কোনদিন উনি ঠিক হবেন না, ক্রমশ খারাপই হবেন, আমার মা ক্ষেপে গিয়ে বলল, ওরা যদি সারাতেই না পারে, তাহলে ওখানে রেখে দিক গে যাক, আর বাড়িতে আনার দরকার নেই।
সেই মা শেষদিন অব্দি বাবাকে সব করে দিল। মা চোখের আড়াল হলেই বাবা আ আ করে চেঁচায়। যে বাবার কথার পটুত্বের জন্য লোকে ধন্য দিত, সেই বাবা। একদিন তারপর বাবা সেরিব্রালে হঠাত গেল। মা মুক্তি পেল। চার পাঁচদিন পর একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তিনবছর পর আবার আয়নায় নিজেকে দেখলাম। আমার মাথাটা এত সাদা তো ছিল না রে।
বাবার দ্বিতীয় শৈশবে মা নিজের বাকি কালো চুলগুলো পাকিয়েছিল।
আমি ভাবি, পরমেশ কবে ওইরকম হবে। এখন আমাকে দোষে, বয়সের গরম কমে গেছে বলে চীৎকার কম করে। আমি সেবাযত্ন করব আশা একরকম যখন ছেড়েই দিয়েছে, আমি তখনই বাড়ির দেখভাল শুরু করলাম। ওর জন্য ভাজা শুকনো লঙ্কা ঝোলে দিয়েই তুলে নিই, যাতে গন্ধ হবে, ঝাল হবে না। সেদ্ধর ওপর চিকেন রাঁধি, খুব যত্ন করে ওর জলখাবার বানাই। ওট, বাজরা, মকাই দিয়ে রুটি করে দিই।

আমি বারান্দায় দাঁড়াই।
টুকরা সাদা মাসিমার বারান্দায় শুয়ে আছে। মাসিমার মেয়ে উইলচেয়ার করে দিয়ে গেছে মাসিমাকে। পা দুটো একেবারে গেছে ওনার। মুখ এখনো ছোটে।
চাকা ঠেলে নিজেই বারান্দার দরজায় এসে চেঁচাচ্ছেন, টুকরা, পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস কেন । ওঠ । তখন পাম্প চালিয়ে দিয়ে এসেছিলি, ভুলে গেছিস বন্ধ করতে। আমার পাম্পটা  জ্বলে গেল বোধ হয়।  জল ফুরিয়ে সেই থেকে গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। এই লোককে দিয়ে কী করে আমার কাজ হবে রে?
আজই তোকে তাড়াব, মেরে তাড়াব। দাঁড়া।
গত বাইশ বছর ধরে এমন বলছেন মাসিমা। মাসিমার মেয়েরা মাসিমাকে কিছু কেনাকাটা করে যায়। বাকিটা ওই টুকরাই দেখে। টুকরার সঙ্গে মাসিমার কেমন অদ্ভুত একটা সম্পর্ক যেন।  আমি কেন ওদের এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি?
আমি জানি না। মাসিমা মারা যান যদি, ঐ বাড়ি প্রোমোটারের হাতে চলে যাবে, সবাই বলাবলি করে। মেয়েরা কি এই লায়াবিলিটি টানবে? পুরনো বাড়ি, ভাঙা বাড়ি।
টুকরা তখন কোথায় যাবে?

No comments:

Post a Comment